রবিবার - মে ১৯ - ২০২৪

ম্যাপেল গাছের বিস্ময়

একটি দেশের জাতীয় পতাকার আকৃতি রং প্রতীক ইত্যাদি বিশ্লেষণ করলে বুঝে নেয়া যায় দেশটির উপরে প্রকৃতি, সংস্কৃতি বা রাজনীতির প্রভাব কতটুকু। খুব সামান্য ক’টি দেশই আছে পৃথিবীতে যাদের পতাকায় উঠে এসেছে প্রকৃতি। নরফক আইল্যান্ডের পতাকায় আছে পাইনের ছবি, ইরিত্রিয়ার পতাকায় অলিভ গাছের ডাল, লেবাননে সিডার গাছ, হংকংয়ে অর্কিড ফুল এবং কানাডার পতাকায় শোভা পেয়েছে একটি বড় আকারের ম্যাপেল পাতা। পাতাটির ১১টি কোণ আছে যা কানাডায় পাওয়া যায় এমন ১০টি ম্যাপেল প্রজাতির গাছের সাধারণ প্রতীক মাত্র, যুক্তরাষ্ট্রের তারকাচিহ্নের মতো তা কোনো রাজ্যের সংখ্যা নিরূপণ করে না। ম্যাপেলের সঙ্গে কানাডার সম্পর্ক কতটা নিবিড় তা পতাকার ডিজাইন থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়। পতাকার কম্পোজিশনে দুপাশে যে বিশদ লাল অংশটুকু দেখা যায় তা প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত সৈনিকদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনহেতু।
ম্যাপেল গাছ বিখ্যাত হয়েছে এর অসাধারণ সুগন্ধি রসের কারণে। ৩০০ বছর আগে থেকে এই রস সংগ্রহের খবর পাওয়া যায়। কানাডার ইরোকুয়া, মিকম্যাক প্রভৃতি নেটিভ ইন্ডিয়ানদের কাছ থেকে ইউরোপীয় আবিষ্কারকগণ এই রসের অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রথম জানতে পারে। নেটিভ ইন্ডিয়ানরা লক্ষ্য করেছে, কোনো ভাঙা ডাল থেকে বেরিয়ে আসা বিন্দু বিন্দু রস চুইয়ে পড়তে পড়তে জমে যায় ঠাণ্ডায়। এর স্বাদ পরখ করেছে তারা, মিষ্টি। অথচ ম্যাপেলের রস খুব পানসে। এই মিষ্টত্বের কারণ, বরফ থেকেও জল উবে যায় এবং মিষ্টি স্বাদ ক্রমশ গাঢ় হতে থাকে। ফ্রিজে রাখা আইস কিউবও জল হারানোর কারণে ধীরে ধীরে ছোট হতে থাকে।
বিশ্বব্যাপী নন্দিত এই রসে সুগারের পরিমাণ কিন্তু খুবই কম, শতকরা দুই-আড়াই ভাগ মাত্র। হিসাব করলে দেখা যায়, ৪০ গ্যালন রস জ্বাল করলে পাওয়া যায় মাত্র এক গ্যালন পানীয় রস। এ কারণে এক গ্যালন রসের মূল্য প্রায় ৪০ ডলার। গড়ে এক গাছ থেকে মাত্র এক গ্যালন সুপেয় রসই পাওয়া যায়। তবে গাছের সংখ্যা বেশুমার, সুগার ম্যাপেলের ফরেস্টে বা সুগার বুশ-এ মাইলের পর মাইল ধরে এই গাছের রাজত্ব। নেটিভদের সুগার থেকে জল দূর করার প্রাচীন পদ্ধতি ছিল, সংগৃহীত রসকে গাছের কাণ্ড খোদাই করা পাত্রে ঢেলে রাখা। ঠাণ্ডায় জল জমে বরফ হয়ে গেলে তাকে আলাদা করে ফেলা। কিন্তু এর চেয়ে ভাল উপায় বের হল পরে, জ্বাল দিয়ে পানি বাষ্প করে ফেলা। আগে বাকেট দিয়ে এই রস সংগ্রহ করা হত, জমা করা হত বড় লোহার চৌবাচ্চায় জ্বাল দেয়ার জন্য। এখন সেই বাকেটের যুগ চলে গেছে, লাগানো হচ্ছে প্লাস্টিক টিউব। এই টিউবের নেট ওয়ার্ক এত নিবিড় যে সুগার বুশে ঢুকতে গিয়ে মনে হয়েছে টিউবের জটা জালে জড়িয়ে পড়ছি, দুকদম আয়েশ করে হাঁটার উপায় নেই।

- Advertisement -

এই টিউবগুলো লাগানো হয় ড্রিল করে। ছিদ্র করতে গিয়ে যখন সাদা স্যাপ-উড বের হয়ে আসে তখন রস প্রাপ্তি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে লাগানো হয় ট্যাপ যার মাথায় আটকানো থাকে টিউব। এই টিউবগুলো আবার অপেক্ষাকৃত মোটা টিউবের সঙ্গে যোগ করা হয় কারণ প্রবাহিত রসের পরিমাণ ক্রমশ বাড়তে থাকে। শেষের দিকে বেশ মোটাসোটা পাইপের মধ্য দিয়ে রস এসে জমে সুগার হাউসে, যেখানে দিবারাত্র জ্বাল করা হয় রস। বনের মধ্যে ধোঁয়া ওঠা ঘর দেখলেই বোঝা যায় সুগার হাউস চালু আছে। সর্বশেষ প্রযুক্তিতে রস সংগ্রহের জন্য পাইপের প্রান্তে লাগানো হয় ‘ভ্যাকুয়াম সাকশন পাম্প’ যার ফলে রসের পরিমাণ বেড়ে যায় প্রায় ৩ গুন। এপ্রিল পর্যন্ত মাস তিনেক রস সংগ্রহের পর টিউবগুলো ধোলাই করে পরের বছরের জন্য রেডি করে রাখা হয়। ধোলাই না করলে এর ভেতর ব্যাক্টেরিয়া ও ছত্রাকের আক্রমণ হয়। সমস্যা হল, ধোলাই করার সময় ব্যবহার করা হয় ‘আইসোপ্রোপাইল অ্যালকোহল’ (IPA)। টিউব প্রযুক্তিতে অ্যালকোহল ব্যবহারের বিষয়টি কিছুটা বিতর্কিত, এটি কতটা স্বাস্থ্যসম্মত এ নিয়ে দেখা গেছে মতান্তর। যারা মদ্যপান করেন না তারাও পরিহার করে চলেন ম্যাপেল সিরাপ।
ম্যাপেলের একশ’রও বেশি প্রজাতি রয়েছে। সব প্রজাতি থেকেই রস পাওয়া যায় তবে পরিমাণ ও ফ্লেভার নিয়ে কথা। সুগার ম্যাপেল (Acer saccharum), ব্লাক, রেড ও সিলভার ম্যাপেল থেকেই সাধারণত রস সংগ্রহ করা হয়। মজার ব্যাপার হল, রাশিয়া, আলাস্কা প্রভৃতি দেশে রস সংগ্রহ করা হয় বার্চ গাছ থেকেও যেমনটা করা হয় আমেরিকার হিকরি বা ওয়ালনাট গাছ থেকে। তবে সমস্যা হল, বার্চের রসে সুগারের পরিমাণ থাকে মাত্র ১ শতাংশ। অতএব রসকে জল বিমুক্ত করা আরো কঠিন, ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ। কানাডার বেশির ভাগ ম্যাপেল সিরাপ তৈরি হয় ৪টি প্রদেশ- কোয়েব্যাক (Quebec), অনটেরিও (Ontario), নিউ ব্রাঞ্জউইক (New Brunswick) ও নোভা স্কোশিয়াতে (Nova Scotia)। পৃথিবীর ৮৫ শতাংশ ম্যাপেল সিরাপ তৈরি হয় কানাডাতে।

ম্যাপেল রসের স্বাদ ও বিশেষত্ব ঠিক বোঝানো যায় না। এর ফ্লেভার ভ্যানিলা, ক্যারামেল ও প্রুনের একটি মিশ্রিত ঘ্রাণের মত মনে হয়। মধুতে চিতি পড়ে না কিন্তু ম্যাপেলে তা দেখা দেয় যে কারণে ফ্রিজে রাখতে হয়, যাতে প্রায় বছরখানেক রাখা যায়। বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুত ম্যাপেল সিরাপের রং দেখা যায় মোটামুটি ৩ রকম- গোল্ডেন, অ্যাম্বার ও ডার্ক। মাপেলের ফ্লেভার সবচেয়ে বেশি থাকে অ্যাম্বারে। বেশির ভাগ মানুষ এটাই পছন্দ করে। গোল্ডেন ভ্যারাইটি অত্যন্ত মিষ্টি, আর যেটা ডার্ক তা প্রায় গুড়ের মত নিবিড় গন্ধযুক্ত, আমার অন্তত খেতে ভাল লাগেনি। ডার্ককে আরো জ্বাল করলে তৈরি হয় ম্যাপেল সুগার যা বেশ দাম দিয়ে কিনতে হয়। যখন ম্যাপেল গাছে কলি দেখা দেয় এবং সেগুলো ফুটতে থাকে তখন রসের রং কিছুটা সবুজাভ হয়ে পড়ে, স্বাদেও কিছুটা কটুতা দেখা দেয়।
বাজারে যে সব প্রচলিত ম্যাপেল সিরাপ দেখা যায় তার অধিকাংশই আসল নয়। ‘আন্ট জেমিমা’ বা ‘লগ কেবিন’ জাতীয় বিখ্যাত ম্যাপেল সিরাপ প্রস্তুতকারকদের রসেও মিশ্রিত থাকে ইক্ষুরস, অন্যান্য সুগার, লেমন জুস ইত্যাদি। প্যানকেক-এর ওপরে ফ্লেভার দেয়ার জন্য যে ম্যাপেল সিরাপ বাজার থেকে কিনে আনা হয় তার প্রায় পুরোটাই ‘কর্ন সিরাপ।’ লগ কেবিনের অ্যাডে লেখা থাকে ‘Authentic Maple tasting syrup for over 120 years’, যা থেকে বোঝা যায় এতে শুভঙ্করের ফাঁক রয়েছে, আসল ম্যাপেল সিরাপ নয়, ‘ম্যাপেল টেস্টিং সিরাপ।’
সুগার ম্যাপেল (Acer saccharum) গাছ স্বাভাবিকভাবে ৭০-৮০ ফুট উঁচু হয় তবে ১০০ ফুটও ছাড়িয়ে যেতে পারে পুরানো গাছ হলে। প্রায় ৩০০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। ভূদৃশ্য তৈরিতে এই গাছের ব্যবহার অনেক। জাপানি ম্যাপেল গাছ ইনডোরে রাখা যায় এবং এর থেকে নির্মাণ করা হয় দৃষ্টিনন্দন বনসাই। এর বীজগুলো দেখতে হেলিকপ্টারের মত, বাতাস বেশি হলে পাখনায় ভর করে বহুদূর উড়ে যেতে পারে। এসব বীজ খায় হরিণ, মুস, খরগোস, কাঠবিড়ালী, জাব পোকা (Aphid) প্রভৃতি প্রাণী। মানুষও খায় এর বীজ। শীতকালের বীজ ও ছোট বীজ খেতে স্বাদু, বড় বীজ তিতকুটে লাগে। বীজ থেকে ম্যাপেলের চাষ করা যায়। দিন দুই জলে ভিজিয়ে ফ্রিজে মাস তিনেকের মতো স্ট্রাটিফিকেশন করতে হয় অঙ্কুরোদ্গমের জন্য। গাছের বাকল মিষ্টি বলে সজারু এই গাছের বাকল খায়। এসব গাছের নিচে ছায়া থাকলেও ড্যাফোডিল, টিউলিপ ইত্যাদি গাছ জন্মাতে পারে। ম্যাপেল ফুলে বায়ু পরাগায়ন মুখ্য হলেও পোকামাকড়েরও কিছু ভূমিকা আছে।
ম্যাপেল গাছে কি পরিমাণ রস হবে তা কিছুটা অনুমান করা যায়। যে বছর বীজ খুব বেশি হয় গাছে তার পরের বছর রসের পরিমাণ কমে যায়। আবার বীজের পরিমাণ কম হলে পরবর্তীতে রসের পরিমাণ বাড়ে। এর কারণ সুগার ও বীজ দুটোই তৈরি করতে গাছের শক্তি দরকার হয় যা আসে কার্বোহাইড্রেট থেকে। একটির উৎপাদনে এই শক্তি খরচ হয়ে গেলে অন্যটির উৎপাদন ব্যাহত হয়। মার্চ মাসে পরিবেশের তাপমাত্রাও এর জন্য দায়ী। তাই বীজ বর্তমান বছরে কম হলেও সব ক্ষেত্রে আগামি বছর রস বেশি নাও হতে পারে। রাতে ফ্রিজিং কোল্ড, দিনে বেশ গরম এমন পরিবেশেই রস বেশি নামে। একটি তরল সংবাহী উদ্ভিদে থাকে জাইলেম ও ফ্লোয়েম নালিকা। জাইলেমের ভেতর দিয়ে শিকড় থেকে পানি, মিনারেল, এমনকি কিছু হরমোন ও সুগার গাছে প্রবাহিত হয়। জলের উর্ধগতির জন্য কাজ করে উদ্ভিদের প্রস্বেদন, রুট প্রেশার ও স্টেম প্রেশার। ফ্লোয়েম থেকে সারা গাছে সরবরাহ হয় সালোকসংশ্লেষণে উৎপাদিত কার্বোহাইড্রেট যা গাছের বৃদ্ধি, ফুল ফল তৈরিতে কাজে লাগে। যে সব অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট অবশেষ থাকে তা সুগার আকারে জমা হয় গাছের কোমল কাষ্ঠে (Sap)। ইক্ষুর জাইলেম ও ফ্লোয়েম দুটো থেকেই সুগার পাওয়া যায়। ম্যাপেলের মিষ্টি রস সংগ্রহ করা হয় জাইলেম থেকে।
পৃথিবীর বহু রকম তরল সংবাহী উদ্ভিদ থেকেই রস সংগ্রহ করা সম্ভব যা ব্যবহৃত হতে পারে মিষ্টি রস, মদ্য ও ভিনেগার তৈরিতে। আফ্রিকান অয়েল পাম (Elaeis guineensis) ও রাফিয়া পাম (Raphia hookeri) থেকে রস সংগ্রহ করা হয়। পৃথিবীর প্রায় ৯০টি দেশে নারকেলের পুষ্পমঞ্জরী কেটে সংগ্রহ করা হয় সুমিষ্ট রস, কেনিয়াতে যার নাম ইমনাজি (Mnazi)। আমাদের দেশের খেজুর (Phoenix spp), গোলপাতা গাছ (Nypa fruticans), তালগাছ (Borassus spp) ইত্যাদি উদ্ভিদ থেকে রস পাওয়া যায় যা তুলনামূলকভাবে অনেক মিষ্টি। এসব প্রচলিত গাছ ছাড়াও নারকেল বা ফিসটেল পাম (Caryota urens) থেকেও ট্যাপ করা যায় রস। তবে এসব রস সংগ্রহের জন্য কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে- ট্যাপ করে কী পরিমাণ রস পাওয়া যাবে, এতে সুগারের পরিমাণ কেমন এবং এর ফ্লেভার কতটা গ্রহণযোগ্য হবে।

 

- Advertisement -

Read More

Recent