রবিবার - মে ১৯ - ২০২৪

প্রিন্স অব বটানিস্টস্‌

যাচ্ছিলাম সুইডেনের উপ্‌সালা ইউনিভার্সিটিতে কনফারেন্সে অংশগ্রহন করার জন্যে। ইংল্যান্ডের নটিংহাম থেকে আমাদের সাথে যাচ্ছিলেন প্রফেসর ই,সি,ককিং এবং ১১ জন ছাত্র-ছাত্রীর একটি গ্রুপ। হাতে কিছুটা সময় থাকাতে হিথ্রো এয়ারপোর্টের ডিউটি-ফ্রি শপে ঘুরছিলাম। সাথে আমার তাইওয়ানের বান্ধবী ওয়াং। সময়ের দিকে খেয়াল ছিল না। হঠাৎ ঘোষণায় শুনলাম, আমাদের দুজনকে খোঁজা হচ্ছে ইমিডিয়েটলি বোর্ডিং করার জন্য। তাড়াতাড়ি দৌড়ালাম। ভয় হচ্ছিলো, বাকি ওরা কি ভাবছেন আমাদের দেরিতে। প্লেনের ভেতরে ঢুকে অন্য রকম অভিজ্ঞতা হল। গ্রুপের সবাই মিটি মিটি হাসছেন আমাদের দিকে তাকিয়ে, যেন খুব মজার একটা ব্যাপার ঘটেছে। আমার সিট খুঁজে পেলাম ঠিক প্রফেসরের পাশেই। হাসির কারণটা বোধগম্য হলো এবার। ভদ্রোলোক মোটামুটি নামকরা এবং বিশিস্ট একজন ব্যক্তি। গ্রুপের কেউ চায়না জার্নিতে প্রফেসরের পাশে বসতে। কারণ উনি সারাক্ষণ প্রফেশনাল গল্প করে বোর করে দেন পাশের ব্যক্তিকে।
প্রফেসর আমাকে বোর করেননি। উনি গল্প শুরু করলেন “লিন্নে”কে নিয়ে। অসীম শ্রদ্ধা নিয়ে বলছিলেন সুইডেনে লিন্নের বিভিন্ন অবদানের কথা। কিভাবে লিন্নে প্রাণীজগতের শ্রেণিবিন্যাসের কাজের সাথে যুক্ত হলেন। জানালেন, সারা সুইডেনের মানুষ কিভাবে তাঁকে ভক্তি করে এবং ভালোবাসে। লিন্নে সম্পর্কে প্রফেসর এত বেশি জানতেন যে পুরো জার্নির সময়টা ঐ গল্প শুনতে শুনতে কখন কেটে গেছে বুঝতেও পারিনি। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম আর ভাবছিলাম কখন স্বচক্ষে দেখব লিন্নের উপ্‌সালা, লিন্নের বাগান, লিন্নের বাড়ি। আকাশ ভ্রমণের এই স্মৃতিটুকু অক্ষয় হয়ে আছে আমার কাছে। লিন্নেকে নিয়ে প্রফেসরের সাথে অসাধারণ একটি সময় কাটানো। অসাধারণ এক স্মৃতি যা সবার সাথে শেয়ার করার ইচ্ছেটা দমন করতে পারলাম না। এই লিন্নেই হলো ক্যারোলাস লিন্নিয়াস (Carolus Linnaeus)। সুইডেনে, সুইড-রা তাঁকে ভালোবেসে ডাকেন ‘লিন্নে’ বলে। এই ভালোবাসার সাথে মিশে আছে অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং সন্মান।
ক্যারোলাস লিন্নিয়াসকে কার্ল লিন্নিয়াসও (Carl Linnaeus) বলা হতো। কার্ল লিনিয়াস (১৭০৭-১৭৭৮) সুইডেনের রাশাল্টে (Råshult) জন্মগ্রহন করেন। তিনি একাধারে ছিলেন একজন উদ্ভিদ বিজ্ঞানী, প্রাণী বিজ্ঞানী এবং একজন চিকিৎসক। তাঁকে আধুনিক ট্যাক্সোনোমির জনক (father of modern taxonomy) বলা হয়। তাকে একই সাথে আধুনিক ইকোলজিরও একজন জনক বলা হয়। পাঁচ বছর বয়সেই তাঁর নিজস্ব একটি বাগান ছিল। যাকে তিনি পরে বলেছেন, “বাগানটি আমার আত্মাকে উদ্দীপিত করেছিল গাছের প্রতি অনির্বাণ ভালবাসা থেকে”। তাঁর জীবনের বেশির ভাগ শিক্ষাই তিনি গ্রহন করেন উপ্‌সালা ইউনিভারসিটি থেকে।
১৭৩৫ থেকে ১৭৩৮ সন পর্যন্ত সময়টা তিনি সুইডেনের বাইরে বাস করেন। উদ্ভিদের উপর তার বৈজ্ঞানিক গবেষণা শুরু হয় যখন তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং উদ্ভিদের খাদ্যগুনের উপর পড়াশোনা করছিলেন। তখনই লিন্নিয়াস অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে প্রাণী এবং উদ্ভিদের শ্রেণিবিন্যাসের যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছিল তা ছিল অসম্পূর্ণ এবং একই সাথে দূর্বোদ্ধ। ১৭৪১ সনে লিনিয়াস উপ্‌সালা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। তিনি উদ্ভিদ বিজ্ঞান, প্রাণী বিজ্ঞান এবং অন্যান্য বিষয় পড়াতে থাকেন। একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি তাঁর ছাত্রদের মাঝে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। ১৭৫০ এবং ১৭৬০ সনে তিনি প্রাণী, উদ্ভিদ এবং মিনেরাল্‌স্‌ সংগ্রহ করেন এবং তাদের শ্রেণিবিন্যাস করতে থাকেন। ১৭৭০ সালে তিনি সুইডেনের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমন করেন, বিভিন্ন ধরণের উদ্ভিদ এবং প্রাণী খুঁজে বের করার জন্য এবং তাদের শ্রেণিবিন্যাস করার জন্য।
কার্ল লিন্নিয়াসের সবচাইতে বড় অবদান ছিল ট্যাক্সোনোমিতে আধুনিক বাইনোমিয়াল নোমেনক্লেচার পদ্ধতির প্রচলন করা। প্রতিটি প্রজাতির একটি জেনেরিক নাম থাকবে এবং একটি প্রজাতি নাম (এপিথেট) থাকবে। ১৭২৫ সনে যখন তিনি নেদারল্যান্ডে পড়াশুনা করছিলেন তখন তাঁর কাজের উপর প্রথম বই প্রকাশিত হয় Systema Naturae, যা ছিল একটি চলমান কাজ এবং পরবর্তীতে এর অনেকগুলো ভলিউম বের হয়। তাঁর শ্রেণিবিন্যাসের ধারণা দিনে দিনে বদলাতে থাকে এবং তিনি তা Systema Naturae এ যোগ করতে থাকেন। যতই বেশি নতুন উদ্ভিদ এবং প্রাণীর সন্ধান পেতে থাকেন তিনি তা যোগ করতে থাকেন। যদিও বাইনোমিয়াল নোমেনক্লেচার পদ্ধতি তাঁর আগেও প্রচলিত ছিল। তিনি প্রাচীন পদ্ধতিটির সংস্করণ করেন এবং ব্যাপকভাবে চালু করেন বিজ্ঞানীদের মধ্যে। তখন থেকেই উদ্ভিদ বিজ্ঞানে, কোন প্রজাতির বাইনোমিয়াল নামের শেষে অথরের নামের সংক্ষিপ্ত অক্ষর L. বা Linn (লিন্নিয়াস) ব্যবহার করা শুরু হয়। তাঁর বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার শুরু হয়েছিল ধর্মের উপর ভিত্তি করে। তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে তিনি বিশ্বাস করতেন যে, সৃষ্টিকর্তাকে তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়েই সবচাইতে ভালো করে বোঝা যায়। বিবর্তনবাদ সম্পর্কে লিন্নিয়াসের ধারণা ছিল মডার্ন থিয়োরি থেকে একেবারেই ভিন্ন। তিনি বিশ্বাস করতেন প্রজাতিরা অপরিবর্তনশীল। যদিও তিনি বলেছেন যে, ন্যাচারালি নতুন প্রজাতির সৃষ্টি সম্ভব হতে পারে কিন্তু তার পরিমান এবং সম্ভাবনা খুবই সীমিত। ১৭৪৭ সালে তাঁকে চিফ রয়াল ফিজিসিয়ান মনোনীত করা হয়। ১৭৫৮ সনে তাকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করা হয় এবং একই সময়ে তাঁকে Carl von Linné নামেও সন্মানিত করা হয়। মৃত্যুর পূর্বে তিনি ইউরোপের একজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী হিসেবে খ্যাত ছিলেন এবং তাঁকে প্রিন্স অব বটানিস্টস্‌ বলে সন্মান করা হতো।
উপ্‌সালাতে লিন্নের বাগানকে বলা হয় উপ্‌সালার স্বর্গ। লিন্নিয়াস গার্ডেন ছিল সুইডেনের প্রথম বোটানিক্যাল গার্ডেন যা সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় তাঁর জন্মেরও আগে ১৬৫৫ সনে। বাগানটি ফ্রেঞ্চ স্টাইলে তৈরি করা হয়। পরবর্তীতে লিন্নিয়াসের ডিজাইনে একে নবায়ন করা হয় ১৭৪৫ সনে। এখন সেখানে ১৩০০ প্রজাতির গাছ লাগানো হয় নিয়মিত। প্রতিটি গাছই লিন্নিয়াসের ডিজাইনে এবং তাঁর নির্দেশিত পদ্ধতিতে লাগানো হয়। সবগুলো প্রজাতি লিন্নের পছন্দ মত তাঁর নিজস্ব জমিতে লাগানো হয়েছে। এই বাগানটির সাথেই ছিল তাঁর প্রফেশনাল রেসিডেন্স, এক্সিবিশন এবং ক্যাফে শপ। বাগানটি প্রতি বছর প্রদর্শন শুরু হয় মে মাসের প্রথমে এবং শেষ হয় সেপ্টেম্বরের শেষে। এর পর সুইডেনে শীত পড়ে যায়। ইচ্ছে থাকলেও বাগান আর সতেজ রাখা যায় না।
কার্ল লিন্নিয়াসের সামারবি এর বাড়িটি এখন মিউজিয়াম। সুইডিশ লিন্নিয়াস সোসাইটি তার দেখাশোনা করেন। মিউজিয়ামটি সারা বছরই খোলা থাকে এবং এখানে যাওয়ার জন্য আগে থেকে বুক করতে হয়। লিন্নের বাড়ি এবং বাগান দেখবার সৌভাগ্য হল। বাড়িটি সাধারণ কিন্তু কয়েক একর জমির উপর গড়ে উঠেছে তাঁদের পারিবারিক বাগান। তাঁর বিশাল বাগানটি ঘুরে ঘুরে দেখার সময় আমাদের ট্যুর গাইড একটি ছোট্ট ঝোপের সামনে এসে থেমে গেলেন। গাছটির দিকে মমতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন কয়েক মুহূর্ত … তারপর বলতে শুরু করলেন.. এই গাছটি ছিল লিন্নের খুবই প্রিয়। একবার লিন্নের খুবই আদরের ছোট্ট মেয়ের খুব জ্বর হয়। কিছুতেই জ্বর কমাতে পারছিলেন না ডাক্তার। জ্বরের প্রকোপে মেয়ের গায়ের রং বেগুনি হয়ে যায়। মাথা ঠিক রাখতে পারেননি লিন্নে। ছুটে চলে যান বাড়ির পেছনের বাগানে। অনেকক্ষণ বসেছিলেন, হঠাৎ খেয়াল করলেন তিনি একটা ছোট্ট বুনো ঝোপের সামনে বসে আছেন যাতে ছোট ছোট বেগুনি রঙের ফুল ফুটে আছে। বেগুনি ফুলগুলো তার জ্বরে পুড়ে যাওয়া ছোট্ট মেয়েটির কথা মনে করিয়ে দিলো। তিনি অবাক হয়ে ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন মমতার দৃষ্টি নিয়ে। তাঁর মেয়েটিও এমনই বেগুনি হয়ে গেছে। তাঁর মনে হচ্ছিলো, বুনো ঝোপটা তার মেয়ে হয়ে তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এমনই একসময় খবর এলো তাঁর মেয়ের জ্বর কমে গেছে। আনন্দে আত্মহারা লিন্নের মনে হলো বুনো ঝোপটাই তার মেয়ের রূপ ধরে তাঁর কাছে চলে এসেছে। সেই ঘটনার পর থেকে ঝোপের ঐ লতাকে বলা হতো ‘লিন্নের মেয়ে’ (Linne’s daughter)।
এরপর উপ্‌সালার যেখানেই গিয়েছি, লিন্নের লতাটা সব সময় আমাদের সাথে থেকেছে। কনফারেন্সের স্বাগত ভাষণে স্টেজের ব্যাক গ্রাউন্ড এর উপর লিন্নের সেই লতা, লিন্নে’স ডটার। রেস্টুরেন্টে খেতে যেয়ে দেখি ন্যাপকিনের উপর সেই লতা আঁকা। কনফারেন্সের রাইটিং প্যাডের উপর একই মনোগ্রাম। এই লতাটিকে তিনি খুব পছন্দ করতেন। লিন্নের নামে যার নামকরণ করা হয় Linnaea borealis। অবাক বিস্ময়ে দেখলাম কি পরিমান সন্মান দেয়া হয়েছে লিন্নেকে পুরো সুইডেনে। বিখ্যাত ফিলোসফার Jean-Jacques Rousseau লিন্নেকে পাঠানো এক মেসেজে লেখেন, “পৃথিবীর বুকে লিন্নের চাইতে বড় এবং মহৎ কোন মানুষকে আমি চিনি না”।

- Advertisement -

স্কারবোরো, অন্টারিও, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent