রবিবার - মে ১৯ - ২০২৪

ওদের চোখ তুলবার সাহস নেই

ছবিমিকা বাউমিস্টার

আমি তখন অনার্স পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে এম এ পড়ি। পঁচাত্তর সাল। আজাদ বাংলাদেশ টোব্যাকোর বড় চাকুরে। বংগবন্ধু তখনো জীবিত। যুদ্ধ আমাদের মত তরুণীদের সুশক্ত করে দিয়েছে। আমরা কথায় কথায় নিজেরটা আর ছাড়িনা। এই যে সন্তান কাঁখে নিয়ে পড়ছি সেও এক কান্ড!
আমি তখন রাত জেগে পড়া করি। মধ্য রাতে ধুলো মুছি। ক্লাশ শেষে অতিথি আপ্যায়ন করি। করি কাঁচা বাজারও। আমাদের বয়ষ্ক সুদর্শন বাবুর্চির নাম দরবেশ আলী। বাজার করতে দিলে তার বার্ধক্য আর দরবেশত্ব মিলে লাগে বিরানব্বুই ঘন্টা। কিন্তু আমি করলে এক ঘন্টা। তাছাড়া পছন্দের জিনিষ পাওয়া যায় মোহাম্মদ পুর নূরজাহান রোডের কোলে বসা বিশাল কাঁচা বাজারে। নামেই কাঁচা বাজার। সেখানে পাকা, আধা পাকা, কাঁচা সব্জী ফলমূলের সঙ্গে মাছওলা, মুরগীওলা, মাংস, শুটকী সবই আছে। আরও আছে বাজারের লাগোয়া আমার খালার বাড়ি। গাড়ি নিয়ে গেলে ঐ এক ঘন্টার মধ্যে চট করে শুধু বাজার না খালামনির হাতের স্বাদু খাবার ও আদর খেয়েও আসতে পারি।
ঈশিতার বয়স তখন বছর দেড় হবে। কিন্তু সে আমার আঠা। রাতের বেলা বিছানায় শুইয়ে দিলে তবেই আমার পড়ার সময়। আমার একটি মেহগনি কাঠের ডেস্ক ছিলো। সেখানে বসলেই হলো কখন যে পেছন থেকে বেয়ে বেয়ে উঠে থপ করে আমার বইর উপর বসে পড়ে তার ঠিক নেই।
পাতলা শীতের রোববার। তো ‘বাজারের ড্রেসে’ আমি মোহাম্মদ পুর বাজারে গেছি। আমার বাজারের পোশাক আলাদা। যে ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে বা সোবহান বাগ মায়ের বাসায় যাই বা রাতে আজাদের সঙ্গে পার্টিতে যাই এ সাজ তা থেকে আলাদা। ‘বাজারের ড্রেস’ নামে আমার সালোয়ার কামিজের একটি সেটই ছিল যার উড়নার কাপড়টা মোটা এবং দৈর্ঘে প্রস্থে সমান। পড়লে গায়ে চাদর হয়ে বসে। কামিজটি ঢিলা নীল ছিটের ঘটি হাতা আর সঙ্গে সিধা সাদা পাজামা। পায়ে প্লাস্টিকের জবা কুসুম মার্কা স্যান্ডেল। আর বাজারে গেলে চোখেমুখে কাজল ফাজল বা লিপস্টিক দেবার প্রশ্নই ওঠে না!
কিন্তু জামা মোটা পরলেই কি আর পাতলা পরলেই কি বা বস্তা পরলেই কি!ওড়না দিয়ে গা ঘিরে রাখলেই কি আর না রাখলেই কি! তুমি হিজাব পরলেই কি বা জিলবাব পরলেই কি। তুমি নারী শিশু হলেও কি! বাংলাদেশের পুরুষ পারভার্টদের কে আটকাবে? ওরা সুযোগে খুঁজে তোমার গায়ে হাত দেবেই। কারন ওরা জানে মেয়েটি লজ্জ্বায় চুপ করে থাকবে।
আমি কিন্তু ঠিকই টের পেয়েছিলাম আমার দিকে কেউ তার চোখের জিহ্বা তাক করে আছে। একটা অদ্ভুত ব্যাপার এই যে শত ভির হোক কেউ যে তোমাকে তাক করেছে তা তুমি ঠিকই টের পাবে। যেমন কোলাহলের মধ্যেও নিজের নাম ধরে কেউ কিছু বললেই ঠিকই কানে লাগে। তো এক মিন্তি টোকাই নিয়ে মুরগীওলাদের সামনে দিয়ে আমি মাছের ভাগাগুলোর দিকে এগুবার সময়ই ব্যাপারটা আঁচ করতে পারি। আমি গাটা আরো ভালো করে ঢাকি আর এদিক ওদিক দেখি। কে ? কে দেখছে আমাকে? আমাকে যেন কেউ ফলো করছে। কিন্তু মাথা তুল্লেই অন্তি দূরে কিছু একটা সরে যাচ্ছিল। বাজারে প্রচুর মানুষ আর সুন্দর সুন্দর শীতের সব্জী। তাজা মাছের উপর জল ছিটাচ্ছে বিক্রেতা। আমাকে দেখেই বলে সেই লোক সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বলে –- আপা আসেন … আপা আসেন, কোন ভাগ নিবেন। বাহ। আমি তার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ভাবলাম খামোখাই ভাবছি না তো যে পুরুষরা কেবল ছোঁক ছোঁক করে, লুইচ্চা ওরা। মেয়েদের স্তনে বা পশ্চাতে চাপ দিয়ে সটকে। কিন্তু এমন নাও তো হতে পারে।
সুতরাং কাচকি মাছ নিয়ে দেখি ষণ্ডা মার্কা সরপুঠি উঠেছে। বাসায় যে কমলার খোসা শুকিয়ে রেখেছি তা দিয়ে বেগুনের সঙ্গে মাখা মাখা করে রান্না কর্লে বেশ হবে। তো মাছ কিনলাম। সব্জীর দিক থেকে কিনবো বেগুন আর ছুরি সীম। কিন্তু পুঠি কিনেই টের পাই সেই চোখ জোড়া অত্যন্ত সন্নিকটে এসে গেছে। আর পরিষ্কার বুঝি এ আমাকেই অনুসরন করছে। এবং তার তীর্যক ধর্ষক চোখ দেখে ফেলি। সজারু গোঁফ, লুঙিপরা ফুলহাতা শার্ট। চোখ পড়তেই যেন হাসলো! আমি কি আর সরপুঠির দামাদামিতে যাই? কিন্তু এই বাজারে আমার নিরাপদে বাজার করার কোনো গ্যারান্টি নাই! এক্ষুনি আমার মিন্তি বাচ্চা নিয়ে ভাগবো। কিন্তু সে ক্রমশঃ এগিয়ে আসতে থাকে। আমিও বাউলি কেটে কেটে বাইম মাছের মত ভাগতে থাকি। বিক্রেতাদের সারির মধ্যে মধ্যে অত্যন্ত সরু জায়গা। মানুষ মানুষকে অনিচ্ছা কৃত ধাক্কা দিচ্ছে। সে ভিন্ন কথা। এমন পরিস্থিতিতে এসে আমি জল বাঁচিয়ে, লোক কাচিয়ে চলায় বেগ আনতে পারছিলাম না। বার বার থমকে পড়ছিলাম আর ঠিক তখনি লোকটির হাত এগিয়ে এলো, আমার বাঁ কনুইয়ের নিচ দিয়ে। আমিও ছিলাম তক্কে তক্কে। ‘দে হাওয়া চাগিয়ে চাপড়’ প্রাণপন এক থাপ্পর! কোথা থেকে যে এত শক্তি পেলাম কে জানে! চড়ের ধাক্কায় বা অনাকাঙ্খিত প্রতিক্রিয়ায় লোকটা এক মুহূর্তের জন্য বেকুব হয়ে গেল। কিন্তু সে একড়ি মুহূর্ত মাত্র। ‘কেন মারলেন কেন মারলেন বলে হাত উঁচু করতেই আমি টাইট করে তার হাত ধরে ফেলি আর দাঁতে দাঁত চিপে নিচুস্বরে বলি, তা হলে সবাইকে চিৎকার দিয়ে বলি আপনি কি করতে যাচ্ছিলেন? বলেছি বটে কিন্তু আমার গা ঠক ঠক করে কাঁপতে থাকে। আমার ছোট হাতে জোর কমে আসে, লোকটা হাত ছাড়াতে শুরু করে। ওর শক্ত হাতের জোরে আমার মুঠো খুলে যেতে থাকে। লোক জমে যায়। আমার টোকাই বাবা আমার কামিজ ধরে পেছনে টানতে থাকে, আম্মা চলেন… আম্মা চলেন। চারিদিকে উত্তেজনা, হুরমুড় করে কিছু লোক আমাকে কিংবা আমার হাতে ধরা লোকটাকে কি কি যেন জিজ্ঞেস করতে থাকে। তাকিয়ে দেখি চীনে জোকের গায়ে লবন পড়লে যেমন লোকটা তেমন হয়ে গেছে। ওর আর আগের চোখ নেই, তেজও নেই। এমন সময় কোথা থেকে ট্রাউজার আর টি শার্ট পরা একহারা গড়নের এক যুবক লাফিয়ে এসে লোকটার হাত ধরে ফেলে আর আমাকে ঈশারা দিয়ে বলেন, ‘আপনি বাড়ি যান।‘
আমি একটি কৃতজ্ঞতার শব্দ বলেই ভিড় ঠেলে দি দৌড়। পেছনে আমার টোকাই। খালের পাড়েই খালামনির বাসা।আমি দ্রুত তাদের ‘আশ্রয়’ নামের বাড়িটির সেই বিশাল তিমি মাছের মত গেটের পেটে ঢুকে যাই। পেছনে টোকাই বাবা। ততক্ষণে বাজারের ভেতর কি চলছে জানিনা। টোকাই বাবাকে বিদেয় করতে গেলে সে বলে, শয়তান বেটা! দেখি গা কি হইছে।
আমি শীতের মধ্যে ঘামতে থাকি। ফ্যান ছেড়ে বসতেই আমার পরীর মত দেখতে কিশোরী দুই খালাতো বোন দোতলা থেকে নেমে আসে। রাজি ও রিমা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলে,
– উপরের বারান্দেদা থেকে দেখছিলাম বাজারে নাকি এক পকেট্মার ধরা পড়েছে! আমি বললাম, পকেট মার নয় প্রুষ পারভার্ট ধরা পড়েছে । ওরা তার কিছুই বুঝলো না, অপ্রত্যাশিত ভাবে আমাকে পেয়ে ওদের চোখ আঙ্গুরের মত ঘন সবুজ হয়ে গেল। কি হয়েছে তা এখানে জানানোর প্রয়োজনই বোধ করলাম না। তবে বাসায় ফোন করে আজাদকে বললাম, আমি এখান থেকে নাস্তা খেয়ে আসছি। তুমি দরবেশ আলীর ধ্যান ভঙ্গ করে রবিবারের হালুয়া- লুচি খাও। মালেকার মাকে বলো ঈশিতাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে গা হাত পা মুছিয়ে তোমার কাছে দিতে’।
এ হলো সেই পঁচাত্তর সালের কথা। তারপর, মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়েছে, আমার সেই ঈশিতা তরুনী হয়েছে। কলেজ থেকে ছুটিতে এসেছে ইসস্তার ব্রেকে। সেদিন বাইরে বিলেতে এপ্রিলের শাওয়ার। আমরা আমাদের ভ্যালেন্টাইন রোডের পুস্পিত পার্থরোডের বাসার বাগানে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম ফুল আর বৃষ্টির লড়াই। জলে টুবটুবা সনালী ড্যাফোডিল তার বাঁকানো ঘাড় থেকে কিভাবে জল ঝেড়ে আবার নড়েচড়ে উঠছে। এরকম সময় কত কিছু মনে পড়ে। ঈশিতা চা নিয়ে এলে আমি তাকে ঐ গল্পটি বললাম। শুনে এমন ভাবে ফিক করে হেসে উঠলো যে কাপ কেঁপে উঠলো।
– মা আমি তো গতবার বাংলা একাডেমি বইমেলায় এক লোককে আমার জুতার শক্ত পেছনটা ওর পায়ে পাড়া দিয়ে অবস্থা কাহিল করে ফেলে ছিলাম। লোকটা কঁকিয়ে লেংচে লেংচে পালিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু টু শব্দ করে নি।
– বলিস কি? আমি কোথায় ছিলাম।
– তুমি আর বাবা সেদিন সামনেই ছিলে।
– হায় আল্লা তাই!
– হ্যাঁ মা ঐ যে, যে বার মেলায় হুমায়ুন আহমেদ আমার কাছ থেকে দু’টাকা নিয়ে আমাকে তাঁর অটোগ্রাফ দিয়েছিলেন!
– বলিস কি, বদমায়েশরা এই এতো ছোটো মেয়ের দিকেও হাত বাড়ায়!
– আমার কোনো মেয়েবন্ধু বাকি নেই, এমন কান্ড হয়নি। যা ভয় পেয়েছিলাম! কিন্তু ঠিক করিনি ?
– অবশ্যই, একদম ঠিক। মহা ঠিক। তবে আমাদের বলতে পারতি।
– কী যে বলো! বাবার যা রাগ আর বলতে বলতে তো লোকটাই পালিয়ে যেতো।
– তা ঠিক।
আজ এই দু’হাজার বাইশে ভাবি ঈশিতারও কন্যা আনাহিতার এখন সেই বয়স। কি ডাকাবুকো আর সুন্দর শক্ত হয়েছে। গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। একদিন ওকেও আমার ও তার মায়ের গল্পটা বলতে হবে।
বলো বালিকারা মা ভৈ মা ভৈ । মনে রেখো ভিড়ের রাস্তা, চিড়ের ফুটপাতে তোমাদেরও সমান দাবি। জনতার আড়ালে সেই সুযোগে কেউ গায়ে হাত দিলেই সঙ্গে সঙ্গে লাগাও ধমাধম। তোমাদের যার যা আছে স্যান্ডেল, ব্যাগ, হাত, পা তাই দিয়ে। আর যদি লাথিটা জায়গা মত দিতে পারো- তাহলে একবারেই কিল্লা ফতেহ! মনে রাখবা, অপরাধী কোনদিন চোখ তুলে তাকাতে পারে না।

- Advertisement -

Read More

Recent