রবিবার - মে ১৯ - ২০২৪

ফ্রাংকফ্রুটের বাবুলভাই, সোমাভাবী ও অন্যান্য

খুব ভোরে বিমান রানওয়ে স্পর্শ করেছে। ল্যান্ডিংয়ের কিছুক্ষন আগে ঘুম ভেঙ্গেছিল। প্রায় ১৮ ঘন্টার লম্বা জার্নি শেষে ক্লান্ত। বিমানের ছোট জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে দেখি ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।ছোট বড় অসংখ্য বিমান রানওয়েতে। এতো বিমান একসঙ্গে কখনো দেখার প্রশ্নই উঠে না। ঘুম ঘুম চোখে অবাক বিস্ময়ে দেখি এয়ার বার্লিন, লুফথানসা, কেএলএম, এয়ার ফ্রান্স, বৃটিশ এয়ারওয়েজ, এমিরেটস, টার্কিশ এয়ার, কাতার এয়ারওয়েজের বড় বড় বোয়িং ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আগে থেকে জানা ছিল পৃথিবীর ব্যস্ত এয়ারপোর্টগুলির অন্যতম ফ্রাঙ্কফুর্ট। মিনিটে মিনিটে বিমান নামছে ও উড়ছে। শান্ত চোখে বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বিস্মিত হয়েছি। এতোটা ব্যস্ত যে তা কল্পনায়ও ছিল না।

কখন যে অন্যযাত্রীদের পিছু পিছু বিমান থেকে নেমেছি মনেও নেই। শত শত যাত্রী ও ইমিগ্রেশন, কাস্টমস, সিকিউরিটি অফিসারদের আনাগোনার মাঝে নিজেকে আবিস্কার করি ইমিগ্রেশন ডেস্কে। মাত্র ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে পাসপোর্টে এরাইভেল সীল নিয়ে ইমিগ্রেশন পার হয়ে আসি। দেশ থেকে রওয়ানা দেয়ার আগে কতজন ইমিগ্রেশন সম্পর্কে ভয় ভীতিজনক কত কিনা বলেছিলেন। সেই সব শুনে কিছুটা নার্ভাস ছিলাম ইমিগ্রেশনে কি না কি হয়! অথচ এখানকার ইমিগ্রেশন ডালভাত লাগলো!

- Advertisement -

যাহোক কনভেয়ার বেল্ট থেকে ল্যাগেজ নিয়ে বিমানবন্দরের বাইরে এসে দাঁড়াতে সিগারেটের নেশা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে । কিন্তু স্মোকিং জোন খুৃঁজতে গলদঘর্ম হতে হলো। সব কিছু জার্মান ভাষায় লেখা।দু’চার মিনিট এদিক সেদিক খোঁজাখুঁজির পর সিগারেটের সাইন পেয়ে যাই। সেখানে দাঁড়িয়ে আয়েশ করে সিগারেট ধরাই।আমার পাশে ধুমপানরত এক ইরানীকে জিগেস করি, ট্যাক্সি কোথায় পাওয়া যাবে?

সে দুঃখ প্রকাশ করে জানায়, আমিও তোমার মতন প্রথম এসেছি জার্মানিতে । এক কাজিন আসবে আমাকে নিতে। অপেক্ষা করো তার কাছ থেকে জেনে নিয়ে জানাবো।

ঢাকায় ৩৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে এসে পড়েছি ৯ ডিগ্রীতে। তীব্র বাতাস আর ঠান্ডায় আমার অবস্থা জবুথবু। বঙ্গবাজার থেকে কেনা  লম্বা-ঝুল কম্বলের মতো মোটা একটা কোট গায়ে চাপিয়েছি। এটা আমার কলিগ এনামুল কিনে দিয়েছে। মাথায় টুপি, গলায় মাফলার পরা সত্ত্বেও আমি শীতে কাঁপছি তখন।

প্রথম এসেছি জার্মানে। এর আগে কখনো ইউরোপ আসা হয়নি। বিদেশ ট্যুর বলতে ভারত ও এশিয়ার কয়েকটি দেশ গিয়েছিলাম। ভাবছি, ইরানী সহযাত্রীর কাজিন থেকে হেল্প নিবো নাকি সামনে এগিয়ে দেখব ট্যাক্সি কোথায় পাওয়া যাবে।

সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে এদিক সেদিকে হাঁটতে থাকি। কোনদিকে যাব, ট্যাক্সি কোথায় পাবো-এরকম উৎকন্ঠায় অন্যমনস্কতায় ধাক্কা লাগে মেয়েটির সাথে। আমি ভয়ে ভয়ে সরি টরি বলে অস্থির।

আমার ভয়ার্ত মুখ দেখে মেয়েটি বেশ মজা পেয়ে বলে, চোখ কি ভুলে ফেলে এসেছো, নাকি ইচ্ছে করে ধাক্কা খেলে?

এবার আমার লজ্জায় মুখ লাল হয়ে গেল। তা দেখে মেয়েটি শব্দ করে হেসে বলে, এনিওয়ে,আই ডোন্ট মাইন্ড। আমি এলেনা, বার্লিনার। তুমি কোথা থেকে এসেছো?

ঢোক গিলে বলি,  আমি সত্যি লজ্জিত।

এবার সে একটু ধমকের সুরে বলে, এতোই যখন লজ্জা পাচ্ছো এরপর দেখে শুনে চলবে।দয়া করে নাম ও কোথায় থেকে এসেছো বলে ফেলো।

-রনি আমার নাম।বাংলাদেশ থেকে এসেছি।

-ওয়াও। আমার অনেক বন্ধু আছে বাংলাদেশী। ওরা খুবই ভাল মানুষ।

বাংলাদেশীরা ভাল মানুষ হয়, এলেনার সার্টিফিকেট আমাকে ভয় কাটাতে সাহায্য করে। আমি কতদিন থাকবো, জার্মান ছাড়া আর কোথাও বেড়াতে যাচ্ছি কিনা এরকম দু’চারটি কথা হয়।

এলেনা চলে যাবার পর ট্যাক্সির দেখা পেয়ে যাই। আফগানী ড্রাইভার আহমেদ, অল্পবয়সের তরুন।খুব ভাল ইংরেজী বলতে পারে। কথায় কথায় জেনে নেই, ফ্রাংকফ্রুটের আজকের আবহাওয়া, যে হোটেলে থাকবো তার আশেপাশের সস্তায় খাবারের দোকান কি রকম আছে।

আহমেদ আমাকে ফ্রাংকফ্রুট সম্পর্কে অল্পকথায় বেশ ভাল ধারনা দেয়।খাবারের জন্য এখানে টার্কিশ ফুডস বেস্ট। দামেও নাকি সস্তা।

আমি পাল্টা জানতে চেয়েছিলাম, আফগান খাবারের কথা কেন রেকোমেন্ড করছো না?

সে জিভে কামড় দিয়ে বললো, সরি,  নিজের দেশের খাবারের কথা বলিনি তুমি আবার কি মনে করো?

তার বিনয়ে মুগ্ধ হয়ে বলি, তোমাদের কাবুলি পোলাও আমার পছন্দ।

আহমেদ বিস্ময়ে জানতে চায়, কোথায় খেয়েছি।

তার বিস্ময় আরো বেড়ে যায়, যখন শুনে ঢাকায় আজকাল কাবুলি পোলাও, পেশোয়ারি কেবাব পাওয়া যায়।

ঢাকা হতে হোটেল বুকিং করা ছিল। চেক-ইন করে  রুমে ঢুকে লম্বা শাওয়ার নিতে শরীর মন ফুরফুরে হয়ে উঠে। হোটেলের রেস্টুরেন্টে ব্রেকফাস্ট ছিল কমপ্লিমেন্টারি। জেলি, ব্রেড, ডিম, কলা, ফ্রুটস জুস ও কফি খেয়ে রুমে ফিরে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাই।

যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন বেলা বেশ হয়েছে। আহমেদের কথা অনুযায়ী হোটেলের পাশে খুঁজে পাই একটা ছোট টার্কিশ রেস্টুরেন্ট। মিটবলস,ইস্কানদর কেবাব, তরতিলা,ডোনার দিয়ে লাঞ্চ করতে ১৫ ইউরো খরচ হয়ে গেল।আমার মতন গরীবের জন্য এটা অনেক বেশী!

বিকেলে হাঁটতে বের হই। মোবাইল কানেকশান নেয়া হয়নি। মুলতঃ সিম কেনার জন্য বের হওয়া। এখানে তেমন একটা ইংরেজী কেউ বলে না। সবাই ডয়েচ ভাষায় কথা বলে। বেশিরভাগই দোকানপাঠের সাইন ডয়েচে লেখা। কোনটা যে মোবাইলের দোকান, কোনটা যে শপিংমল বুঝতে খানিকটা সময় চলে যায়।অপরিচিত রাস্তাঘাট,কিছুই চিনি না। হারানোর টেনশনে বেশিদুর যেতে পারি না। হোটেল ছেড়ে একটুদূর যাই আর ভাবনায় থাকে ঠিকঠাক ফিরতে পারবো তো?

যদি পথ ভুলে যাই কপালে খারাপ কি হতে পারে!

তাই বারবার রাস্তার মোড়গুলো মনে রেখে সামনে এগিয়ে যাই।

রাতে সিম কিনে যখন হোটেলে ফিরে আসি রিসিপশানের মেয়েটি মিষ্টি হেসে চাবি বুঝিয়ে দিয়ে বললো, ‘ মনে হয় তোমার ডিনার করা হয়নি। হোটেলের রেস্টুরেন্টে বসতে পারো অথবা রুমসার্ভিস নিতে পারো। রেস্টুরেন্ট কিন্তু বন্ধ হয়ে যাবে একঘন্টার মধ্যে।’

মেয়েটিকে ধন্যবাদ দিয়ে নাম জেনে নেই। রোজলিন টে। হামবুর্গে মায়ের কাছে দুই সন্তানকে রেখে এই হোটেলে চাকরী করতে এসেছে । যে চারদিন ছিলাম  রাতে তার সাথে দেখা হতো। মিষ্টি আচার ব্যবহারের জন্য তাকে ভুলে যাওয়া সহজ নয়। বাইরে যাবার সময় মাঝে মাঝে  তাঁর কাছে চাবি রেখে যেতাম। ফিরতে রাত হলে মনে হত নীলনয়না মেয়েটি আমার জন্যেই অপেক্ষা করে আছে।

ফ্রাংকফ্রুটে থাকার খরচটাই সবচেয়ে বেশি। খাবার ও ট্রান্সপোর্ট তুলনামুলক সস্তাই মনে হয়েছে। হোটেলে আমার রুম ছিল ১২ তলায়। জানালার পর্দা সরালে দেখা যেত জার্মানির অন্যতম প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র ফ্রাংকফুর্ট শহরের একটি অংশ। এ শহরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে রাইন নদী।পরবর্তীকালে নানান সময় জার্মান এসেছি। প্রতিবারই দেখার সুযোগ হয়েছিল পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর এ নদী ।

কোন এক বিকেলে রাইন নদীতীরের ঘুরতে গিয়ে চোখ জুড়িয়ে গেলো। কোথাও কোনো ময়লা-আবর্জনা নেই, একেবারে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। দু’তীরই বাঁধানো। দর্শনার্থীদের জন্য বানানো হয়েছে পাকা রাস্তা। ক্লান্ত হয়ে বসার জন্য আছে কাঠের বেঞ্চ। কিছুদূর পরপরই ছোট ছোট সেতু। এই সেতু উভয় তীরকে সংযুক্ত করেছে। দু’পাড়ে রয়েছে বড় বড় গাছ। চারিদিকে সবুজ ঘাসের প্রশস্ত ও দীর্ঘ চত্বর। সামারে মানুষের উপচেপড়া ভিড় লেগে থাকে। সবুজ ঘাসের ওপর কোথাও চলছে গান, কোথাও চলছে ছেলেমেয়েদের খেলাধুলার নানা আয়োজন।  অনেক দোকানপাট, অস্থায়ী রেস্টুরেন্ট বসানো হয়েছে। সেগুলোতে অসম্ভব ভীড়। মনে হলো, খাওয়ার জন্য বুঝি এরা এখানে এসেছে!

হাঁটতে হাঁটতে দেখি নানান বর্নের, নানান বয়েসের মানুষজন আসা যাওয়া করছে। কেউ কেউ বেঞ্চে বসে গল্প করছে, খাচ্ছে, কত কী! চারদিকে এতো উল্লাস, এতো আনন্দ কিন্তু কেউ কাউকে বিরক্ত করছে না। ফ্রাংকফ্রুটে আমার একপ্রিয় বড়ভাই, বাবুলভাই জানিয়েছিলেন,জার্মানীরা নদী এবং নদীতীরকে কেবল বিনোদন নয়, অর্থনৈতিক নানা কর্মকাণ্ডের স্থান হিসেবেও ব্যবহার করেছে।

জীবনে চলার পথে আমাদের এমন বহু মানুষের সাথে আলাপ হয় যাদের নামটাও হয়ত জানা হয় না। কিংবা আলাপের স্বল্পতায় নামটা বিস্মৃত হই অথচ মানুষটি মনে থেকে যায়। কিন্তু ফ্রাংকফ্রুটে এমন একজন মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছিল, যিনি মুহুর্তে মানুষকে আপন করে নিতে পারেন। সহজ সরল সেই মানুষটি ও তার স্ত্রীর আন্তরিকতা, আপ্যায়ন কখনোই ভুলে যাওয়ার মতন নয়। আজ বলব সেরকমই দুইজন মানুষের কথা।

দেশ থেকে ফ্রাংকফুর্ট আসার আগে ডুসেলডর্ফ নিবাসী ইঞ্জিনিয়ার হাসনাতভাই বলে দিয়েছিলেন, আমি যেন বাবুল তালুকদারভাইয়ের বাসায় উঠি।

প্রত্যুত্তরে জানিয়েছিলাম, হ্যা যাব কিন্তু দু’চারদিন আমি একা একা নিজের মতন থাকতে চাই।ফ্রাংকফ্রুট ছাড়ার আগে বাবুলভাইয়ের বাসায় যাব।

ফ্রাংকফ্রুটের তৃতীয় দিন বিকেলে বাবুলভাইকে ফোন দিতে হই হই করে উঠেন।

ভাইজান,আপনি কোথায়? আমরা আপনার দেখা পেতে অস্থির হয়ে আছি। এড্রেস দেন, আমি এক্ষুনি আপনাকে নিতে আসছি।

বহু কস্টে তাকে নিবৃত্ত করে অনুরোধ জানাই, আরেকটা দিন সময় দেন।কিছু কাজ আছে সেগুলো সেরে ফ্রি হয়ে যাব। তারপর না হয় আপনার বাসায় দুইদিন কাটিয়ে যাওয়া যাবে।

বাবুলভাই মন খারাপ করেন।

তারপরও আমার প্রস্তাব মেনে নিয়ে শুধু বললেন, আপনার অপেক্ষায় বাসার সবাই থাকবে।

এরপর আমন্ত্রন উপেক্ষা করা যায় না। যাওয়া একরকম ফরজ হয়ে যায়।দুইদিন পরে বাবুলভাইয়ের ফ্রাংকফ্রুট মাইনটালের বাসায় দুইরাত তিনদিন কাটিয়ে বার্লিন চলে যাই।

প্রথম পরিচয় ও দেখায় বাবুলভাই ও তার পরিবার আমাকে আপন করে নেন। তিনটে দিন তাদের সাথে চমৎকার সময় কেটেছে। সারাদিন ঘোরাঘুরি আর রাতভর গল্প,কবিতা,ছড়ায় আমাদের আড্ডা হয়েছে। রাতজাগা আড্ডায় একটু পরপরই এসেছে সোমাভাবীর বানানো মুখরোচক খাবার।

দীর্ঘ তিন দশকের ওপর বাবুলভাই জার্মান প্রবাসী। রাজনীতি সচেতন, সংস্কৃতিমনস্ক। গান,কবিতার পাশাপাশি দারুন ছড়া লিখেন। তার বেশ ক’টি বই প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ও তার পরিবার মনেপ্রানে বাংলাদেশকে বুকে লালন করেন। সময় সুযোগ করে বছরে দুইবার সপরিবারে দেশে ছুঁটে যান। দুই ছেলে এক মেয়ে নিয়ে শান্তির সংসারে বাবুলভাইয়ের স্ত্রী সোমাভাবী একজন অসম্ভব ভাল মানুষ। সদাহাস্যজ্বল এই মানুষটির কাছে পরবাসে পেয়েছি মাতৃস্নেহসম ভালবাসা ও আদর।

হোটেল থেকে আসার সময় আমার হ্যান্ডল্যাগেজের বেল্ট ছিঁড়ে যাওয়ায় ব্যাগ বহন করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। এ অবস্থা দেখে সোমাভাবী পরেরদিন সকালে আমার জন্য ব্লু কালারের একটি স্পোর্টস ব্যাগ কিনে গিফট করেন। ভাবীর পরম মমতায় দেয়া ব্যাগটি আমার জামতলার বাসায় আজো স্মৃতির স্মারক হয়ে আছে।

এরপর আরো দুইবার ফ্রাংকফ্রুটে বাবুলভাইয়ের বাসায় ছিলাম। এই আসা যাওয়ার মধ্য দিয়ে পরিবারটির সাথে আমার দারুন সম্পর্ক গড়ে উঠে। যা আজও অটুট।

মন্ট্রিয়ল, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent