রবিবার - মে ১৯ - ২০২৪

প্রকৃতির এই পরিবর্তনকে দেখার মধ্যেও আনন্দ আছে

ছবি রেজাউল ইসলাম

কানাডা দেশটা সুন্দর। দেশটাকে ভালোবাসার জন্য এখানে অনেক কিছুই আছে।
অসংখ্য লেক, অসংখ্য নয়নাভিরাম স্থান আর ঘন বনাঞ্চল দেশটিকে এক স্বর্গীয় সৌন্দর্য দান করেছে। সামার চলে গিয়ে এখন ফল ঋতু চলছে। এখন এখানে শরৎকাল। প্রকৃতিতে পরিবর্তন আসন্ন। প্রকৃতির এই পরিবর্তনকে দেখার মধ্যেও আনন্দ আছে। যাদের দেখার চোখ আছে তারা প্রকৃতির এই পরিবর্তিত রূপকে আস্বাদন করতে পারে। আর যাদের দেখার চোখ নেই তারা জন্মান্ধের মত কিছুই দেখে না।
জীবনে অনেক মানুষকেই দেখেছি তারা প্রকৃতির মধ্যে কিছুই খুজে পায় না। তারা দেখে না প্রকৃতির মধ্যে নানা রূপ আছে।
অনেক মানুষ জীবন যুদ্ধের কাঠিন্যের কারনেও চোখ মেলে প্রকৃতির রূপকে দেখার সুযোগ পায় না। তাদের কাছে প্রকৃতিতে ফুটে যাওয়া ফুল কিংবা পূর্নিমার আলোর অপার সৌন্দর্য কোন মানে রাখে না। এই কারনেই অনেকের কাছে পূর্নিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি। বাস্তবতার কষাঘাত খুব কঠিন এবং রূঢ। একজন ক্ষুদার্ত মানুষের কাছে এই সবের কোন মানে নেই।
প্রকৃতির রূপ দেখার জন্য মনের স্থিরতা জরুরী। শান্ত, প্রশান্ত মন নিয়ে প্রকৃতির সামনে যেতে হয়। অনেকটা ধ্যানে মগ্ন শান্ত মন নিয়ে প্রকৃতির রূপ আস্বাদন করতে হয়।
এবার করোনাকালে সামারে কিছু জায়গায় যাওয়া হয়েছে। জায়গাগুলি টরন্টো থেকে বেশি দূরে নয়। থাওজেন্ড আইল্যান্ডে গিয়ে রিভার ক্রুইজ ভালো লেগেছে। রিভার ক্রিইজ ছিল আড়াই ঘন্টার। আমাদের রিভার ক্রুইজের নাম ছিল LOST SHIPS । উদ্দেশ্য ছিল সেই দিনকার সূর্যাস্ত দেখা। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য সেদিন আকাশ ছিল মেঘলা। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিটিও হচ্ছিল। সূর্যাস্ত আর দেখা হলো না। জাহাজ দিয়ে যেতে যেতে এখানে দুপাশে অসংখ্য মনোমুগ্ধকর ছোট ছোট দ্বিপ দেখতে দেখতে যাওয়ার মধ্যে অন্য ধরনের আনন্দ আছে। দ্বিপগুলি Privately owned। দ্বিপগুলিতে কটেজের মত থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। আছে বোটে করে সেন্ট লরেন্স রিভার ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ এবং রোমাঞ্চ।
Lost ships ক্রুইজ সেন্ট লরেন্স নদী দিয়ে আমেরিকার সীমানা হয়ে আবার জেটিতে ফিরে এলো। আড়াই ঘন্টার এই ভ্রমণ কোথা দিয়ে পার হয়ে গেলো বুঝতেই পারলাম না। কথায় আছে ভ্রমন আনন্দের এবং উপভোগ্য হলে সময় দ্রুত চলে যায় আর একঘেয়ে হলে সময় যেতে চায় না।
আমাদের দ্বিতীয় ভ্রমনের স্থান ছিল মাসকোকা। Huntsville শহরে অবস্থিত টরন্টো থেকে ২১০ কিলোমিটার দূরে মাসকোকা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এক অপরূপ স্থান। এখানে ৪৭ টি ছোট এবং মাঝারি আকারের লেক আছে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে গেলে ক্লান্তি দূর করার জন্য অনরুটগুলি বেশ সহায়ক। দীর্ঘ ডাইভিং মানে শীড়দাড়া টনটন করা, অনেকক্ষন স্টেয়ারিং ধরে থাকায় হাতে অবসাদ, অনেক সময় চোখেও ঘুম ঘুম ক্লান্তি নেমে আসা ইত্যাদি থেকে মুক্তির জন্য অনরুটে থামাটা জরুরী।
যাইহোক, ভ্রমন পিপাসুদের অনেকটুকু পিপাসা মিটাতে পারে এই স্থান। মূলতঃ এটি কটেজ কান্ট্রি। প্রচুর কটেজ আর পার্কের ঘন ঝোপঝাড় বনবাদাড়ের মধ্যে অসংখ্য ক্যাম্পিংয়ের ব্যবস্থা।
প্রথমে আমরা গেলাম এরোহেড প্রভিন্সিয়াল পার্কে। এখানে একটা বিচের মত আছে। অসংখ্য মানুষ গোসল করার জন্য বিচে নেমে পড়েছে। বিচের অদূরেই ঘন বনাঞ্চল। বিচের স্বচ্ছ পানি আর সবুজ বনাঞ্চলের এক অপূর্ব ল্যান্ডস্কেপ যেন এই পার্ক। এই পার্কের ঠিক উল্টো দিকেই Stubbs Falls। ঘন বনের মধ্য দিয়ে বহু দূর পর্যন্ত একটা ট্রেইল চলে গেছে। এই ট্রেইলটা হাইকিংয়ের জন্য প্রসিদ্ধ। আমরা হাটা শুরু করলাম সেই জলপ্রপাত দেখার জন্য। পথ যেন শেষ হয় না আর জলপ্রপাতেরও কোন নাম নিশানা নাই। অনেক দূর হাটার পর কাছাকাছি কোথাও জলের শব্দ শুনতে পেলাম। আমরা তখন বুঝতে পারলাম Stubbs falls বেশি দূরে নয়। অবশেষে পেয়ে গেলাম সেই জলপ্রপাত। কঠিন শীলার মধ্য দিয়ে পথ করে জলের ধারা নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। খরস্রোতার মত বয়ে চলেছে এর প্রবাহ। অনেক মানুষ এসেছে এই জলপ্রপাত দেখার জন্য। বহু বছর ধরে জমে থাকা শীলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত দেখার মত এই জলপ্রপাত। যাবার সময় ট্রাইলটা দীর্ঘ পথ মনে হলেও ফেরার পথে দীর্ঘ মনে হয়নি। এর পর আমরা চলে গেলাম big bend look out দেখার জন্য। এই স্থানটির একটি প্যানারমিক ভিউ আছে। ইষ্ট রিভারের পানি এসে এই গোলাকার জায়গাটিতে জমা হয়েছে। বেশ উপর থেকে জায়গাটি দেখার জন্য একটি ভিউপয়েন্ট রয়েছে। উপর থেকে big bend look out দেখতে অসাধারণ।
আমাদের পরবর্তী দেখার স্থান ছিল lions look out। অনেক উপরে অবস্থিত এই স্থানটি থেকে মাসকোকার অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। এটা পাহাড়ের টিলার মত উপরে উঠে গেছে। আমরা গাড়ী নিয়ে উপরে গেলাম। উপর থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দৃষ্টি প্রসারিত করে শহরটিকে দেখার মধ্যে অন্য ধরনের রোমাঞ্চ কাজ করে। নিচে দৃষ্টি প্রসারিত সীমার মধ্যে মাসকোকা নদীর পানি থৈথৈ করছে। প্রকৃতির এই রূপ অপার, স্নিগ্ধ, সুন্দর।
দ্বিতীয় দিন আমরা Hutcheson Beach এ গেলাম গোসল করতে। অসংখ্য ছোট বড় ছেলে বুড়ো বিচে সাতার কাটছে। অনেকেই পানিতে খেলা করছে। আবার অনেকেই বিচের বালিতে গা এলিয়ে রৌদ্রের তাপ নিচ্ছে।বিচের পানিতে বেশ কিছুক্ষন থেকে চলে এলাম মূল শহরে।
সবচেয়ে ভালো লেগেছে, অনেক রাতে দল বেধে মাসকোকার রাস্তা ধরে অনেকটা পথ হেটে যাওয়া। ল্যাম্পপোস্টের স্নিগ্ধ আলোয় গল্প করতে করতে পথ চলার আনন্দই অন্যরকম। এরপর হুস করে সবাই মিলে কোন রেস্টুরেন্টে ঢুকে সুস্বাদু কালামারী খাওয়ার মজা রাতের রাস্তায় হাটার আনন্দকে আরো দ্বিগুণ করে তুলে। তবে বলে রাখা ভালো, মাসকোকা দেখার জন্য সামারের চেয়ে ফল ঋতুটা ভালো। এই সময় গাছের পাতাগুলি নানা বর্ণ ধারন করে। মাসকোকা হয়ে উঠে আরো সুন্দর। সেটি দেখার জন্য ভ্রমণ পিপাসুরা ফল ঋতুতে সেখানে ভীড় জমায়।
এবার সামারে এই দুটো ভ্রমনই আমার ঝুড়িতে জমা হয়েছে। এখন ফল এসে হানা দিয়েছে।কিছু দিনের মধ্যে গাছের পাতাগুলো নানা রংগে সজ্জিত হবে। শীত আসার আগেই পাতাগুলি ঝরে যাবে।
ফল কালার দেখা শেষ করে এইবার এই বছরের জন্য ইতি টানবো।

স্কারবোরো, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent