রবিবার - মে ১৯ - ২০২৪

কালরাত

ছবিজসোয়া আরলে

আনমনা হয়ে যায় সামিয়া। ওর শান্ত মুখের উপর দিয়ে বয়ে যায় যেন দুর্বিষহ ঝড়। খানিক সময় চুপ করে থেকে মনে করার চেষ্টা করে সামিয়া কি হয়েছিল? ঘটনা পর্যায়ক্রমে মনে পড়ছে না কিছু। শুধু দুঃসহ স্মৃতিগুলো ভাসছে চোখের সামনে।
বড় চাচার বড় মেয়ে পারুল আপার বিয়ে ছিল ছাব্বিশে মার্চ। সে উপলক্ষে চাচার বাসায় জড়ো হয়েছিল ওরা অনেক আত্মীয়-স্বজন। একটার পর একটা অনুষ্ঠান, পান-চিনি, গায়ে হলুদ, গানবাজনা, মেহেদী মাখা, রঙ খেলায় অনেক দিন পর সেই ছোটবেলার আনন্দ ফিরে পেয়েছিল সামিয়া। দেশের পরিস্থিতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়-স্কুল-কলেজ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। তাই পড়ালেখায় ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। বাচ্চারা যেন গ্রীষ্ম, রোজা, পূজার মতন আলাদা এক ছুটি পেয়ে গেছে। সবাই মনের আনন্দে মেতেছিল বিয়ের ফুর্তিতে। অভিভাবকরাও ছিলেন হাসিখুশি মেজাজে। বংশের প্রথম মেয়ের বিয়ে। আয়োজন ছিল বিশাল। শান্তিবাগে চাচার মস্ত বাড়ি। এখানেই বিয়ে হবে প্যান্ডেল টাঙিয়ে। সব চাচাতো, ফুপাতো, খালাতো, মামাতো ভাইবোন জড়ো হয়েছে বহুদিন পর। সেই ছোটবেলার মতন হৈ চৈ আনন্দে মেতেছে সবাই। আজ সন্ধ্যায় ফিরেছে ওরা বরের হলুদ দিয়ে। গল্প করতে করতে ভাইবোন মিলে রঙিন কাগজ কেটে ঝালর ফুল বানিয়ে ঘর সাজাচ্ছিল অনেক রাত অবধি। খেলা, গান-হাসি নানারকম খাওয়া-দাওয়ায় মাতোয়ারা সবাই। আত্মীয়-স্বজন যারা থাকবেন না তারা আগে আগেই চলে গেছেন। ঢাকার অবস্থা তেমন শান্ত নয় বলে। সামিয়ার আব্বা-আম্মাও ভাই সাব্বিরসহ চলে গেলেন ধানমন্ডিতে ওদের বাসায়, রাত দশটার দিকে। শাহরিয়ার আর সামিয়া পিঠাপিঠি চাচাতো ভাইবোন। একসাথে পড়ালেখা, খেলা, মারামারি করে বড় হয়েছে দু’জনে। আইএসসি পাস করে শাহরিয়ার লন্ডনে পড়ালেখা করতে চলে যায়। বোনের বিয়ে উপলক্ষে এসেছে অনেক দিন বাদে। এবার ছোটভাই পারভেজও যাবে ওর সাথে লন্ডন। পারভেজ এবার কলেজ শেষ করেছে।
শাহরিয়ার আর সামিয়া বিয়ে বাড়ির ধুমধাড়াক্কায় ছাদে গিয়েছিল গল্প করতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমন কাটছে সামিয়ার, শাহরিয়ারের লন্ডনের জীবন, ছোটবেলার মজাদার সেইসব স্মৃতিতে এমন ডুব দিয়েছিল দু’জনে পারিপার্শ্বিকতা প্রায় ভুলে গিয়েছিল।
এমন সময় গোলাগুলির শব্দ, আকাশভরা আগুনের ফুলকি। কিছু বুঝে উঠার আগেই সামনের রাস্তা দিয়ে ট্রাকভর্তি মিলিটারির বহর যেতে দেখে। রাস্তা দিয়ে কিছু লোক লাঠিসোটা, দা-ব্ল¬ম হাতে দৌড়ে যেতে যেতে ঢুকে পড়ে সামিয়াদের বাসায়। ওদের পিছু পিছু মিলিটারি এলোপাতাড়ি গুলি করতে করতে এগিয়ে এসে, ঢুকে যায় বাসার ভিতর। নিচে থেকে হুড়মুড় শব্দ, চিৎকার-চেঁচামেচি শুনতে পায়। সামিয়া ছাদ থেকে নিচে নেমে যেতে চায়। শাহরিয়ার ওকে ধরে আটকায়। ছাদের দরজায় শিকল দিয়ে কয়েকটা পুরনো চেয়ার কাঠ এনে ছাদের দরজার সামনে জড়ো করে, সামিয়াকে নিয়ে পানির ট্যাঙ্কির পেছনের দিকে ছাদের কার্নিশে শুয়ে পড়ে। ভয়ে সামিয়ার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। শাহরিয়ারের বুকের মাঝে থরথর কাঁপতে থাকে। নিচে ঘরের ভিতর মুহুর্মুহু গুলির শব্দে সারাবাড়ি কাঁপছে। নিঃসার হাত-পা-শরীর, কোনো অনুভূতি নেই। কতক্ষণ এভাবে কেটেছে কে জানে। সামিয়ার নিশ্চল শরীর টেনে উঠায় শাহরিয়ার একসময়। ভোরের আলো ফুটছে দিগন্তজুড়ে, লালের আভা ভেসে উঠে।

ছাদের দরজা গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে নিচে নামে ওরা। আনন্দমুখর সাজানো বিয়েবাড়ি মৃত্যুপুরি হয়ে গেছে। নীরব-নিথর-নিস্তব্ধতা চারপাশে। ঘরে ঘরে রক্তের বন্যা আর লাশের স্তুপ। সব কোলাহল থেমে গেছে। সদর দরজার সামনে বড়চাচা আর বড়চাচীর দেহ পড়ে আছে। বাইরে উঠান যেখানে সামিয়ানা টাঙানোর কথা আজ বিয়ের জন্য, সেখানে কয়েকটি অচেনা মানুষ পড়ে আছে মৃত। ঘরের ভিতর যেদিকে যায় রক্তের বন্যা আর নিথর দেহÑভাই-বোন, কাজের লোক আর চাচা-চাচীর। ডুকরে কেঁদে উঠে সামিয়া। শাহরিয়ার এঘর থেকে ওঘরে যাচ্ছে, উপর থেকে নিচে। একজন কেউ কি বেঁচে নাই? প্রতিটি মানুষকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে শাহরিয়ার। ড্রইংরুমে লাল লাল কাগজের ফুল রক্তের সাথে গেঁথে আছে যেন এক একটা লাল শাপলা। কলরবমুখর সব মুখ, প্রাণহীন পড়ে আছে। পারুল আপা সোফার উপর বাঁকা হয়ে পড়ে আছে, মেহেদি মাখা হাত, হলুদ শাড়ি রক্তে মাখামাখি যেন পরে আছে বিয়ের লাল বেনারসী। পরিপাটি ঘরটি ছত্রখান, ভাঙা আসবাব কাঁচের ছড়াছড়ি, দরজা-জানালা ভাঙা।

- Advertisement -

হঠাৎ সামিয়ার মনে হয় ওদের বাসায় টেলিফোন করার কথা। আব্বা, আম্মা, সাব্বির কেমন আছে? টেলিফোনের টেবিলটা উল্টে পড়ে আছে। ফোনটাকে খুঁজে পেলো অনেকদূরে আধভাঙা অবস্থায়। লাইন নাই। শাহরিয়ার বসে আছে দরজার সামনে পড়ে থাকা মা-বাবার লাশের পাশে ভাবলেশ শূন্য। ওর দিকে দৃষ্টি পড়লে এগিয়ে যায় ওর কাছে সামিয়া। কি করব এখন আমরা শাহরিয়ার? পাথরের মতন দৃষ্টিতে তাকায় ওর দিকে শাহরিয়ার। এমন সময় আবদুল চাচা বের হয়ে আসেন ভিতর থেকে। ভূত দেখার মতন চমকে উঠে দু’জনে।

আল­াহ মালিক তোমরা বাঁইচা আছো। আমি রসুই ঘরের ভাঁড়ারে লুকাইয়া ছিলাম। আপন মনে বলতে থাকে চাচা। আল­াহ এ কি রোজ কেয়ামত ঘটাইলা মালিক? আমার সাব বেগম সাব, এমন বেঘুরে কেন মারা গেল মালিক; এ তোমার কেমন বিচার কও।

পারুল আপা গো…পারভেজ ভাই, সাবিনা আপা, একজন একজন করে দেখে আর আকুল হয়ে ডুকরে উঠে আবদুল চাচা। এতদিনের পুরনো কাজের লোক যার সাথে খেলা-আবদার করে শাহরিয়াররা সবাই বড় হয়েছে, আবদুল ওদের সবার চাচা। চোখের জল আর থামে না আবদুুল চাচার। জরিনা, মা গো তোমরা কেমুন আছো? জরিনার মা, বাবা কাদেরÑতোমার মা বইনরে দেইখা রাইখ। এখানে মানুষগুলোর জন্য শোক করতে করতে আবদুল চাচা নিজের পরিবারের লোকের কথা ভাবতে ভাবতে অস্থির হয়ে উঠে। শাহরিয়ার উঠে যায় চাচার পাশে, রক্তজবার মতন চোখ। চাচা থামো, আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে কিন্তু আমাদের শোক করারও সময় নাই, অবস্থা নাই, শব্দ করো না চাচা। বলা যায় না আবার ওরা আসতে পারে।
আমরা এখন কি করব ঠিক করা লাগবে? আর কি কেউ কোথাও লুকায়ে আছে দেখো খুঁজে? যারা মারা গেছে তাদের জড়ো করে দেখি। কেউ কি জ্যান্ত আছে এখনও।

সামিয়া কারা ছিল এবাড়িতে কাল; দেখতো সবার নাম মনে করতে পারো কিনা।
পারভেজ, সোহেল, নিগার, বড়মামী, ছোটচাচা, ছোটচাচী, সিতারা, রোওনক, ছোটখালা, শ্রাবণী, দিদার, ফুলে­ারা কাজের ফুটফুটে মেয়েটি নাচছিল সবার সাথে। আলেয়ার মা, বেগমের মা, খোরশেদ চোখের সামনে সবাই মৃত। অনেকের কথা মনে হয় না।

উপরের ঘরে মনে হয় শব্দ হচ্ছে কেমন যেন বাচ্চা কাঁদছে। তিনজনে দৌড়ে উপরে যায়। ছোটচাচার ঘর থেকে শব্দ আসছে। বাবুয়া, বাবু কাঁদছে। ছোটচাচার তিন বছরের ছেলেটা কাঁদছে। কান্নার শব্দ খুঁজে পাওয়া যায়। শোবার ঘর লাগোয়া সাজঘরে কাপড়ের মাঝে ঢুকে আছে বাবুয়া। বিছানার পাশে নিচে পড়ে আছে ছোটচাচী। আধা বিছানায় আধা নিচে ঝুলে আছে ছোটচাচার দেহ।
বাবুয়া বলে দৌড়ে গিয়ে বুকে তুলে নেয় সামিয়া বাচ্চাটাকে। ভীত বিহবল চোখে সামিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে বাচ্চাটা। সামিয়া বাচ্চাটার মুখে তাকায় ভালো করে। পাতলা একটা জামা গায়ে। ওর মনে হয় ঠাণ্ডা লাগছে। নাকি গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে ভয়ে? সামিয়া ফুলহাতা একটা জামা পরিয়ে দেয় বাবুয়াকে। গলায় চকচক করছে আল­াহু লেখা একটা লকেটসহ বেশ ভারি চেইন। সামিয়ার মা বাবুয়ার জন্মদিনে এক সপ্তাহ আগে ওকে এই সোনার চেইনটা অনেক দোয়া করে দিয়েছিলেন। বিয়ের প্রায় ছয় বছর পর ছোট চাচা-চাচীর এই প্রথম সন্তান। পরিবারে সবার ছোট এই বাচ্চাটা সবার অনেক আদরের।
চাচী মনে হয় ওকে এখানে কাপড়ের নিচে লুকিয়ে ফেলেছিল। সন্তানকে বাঁচাতে পারলেও নিজেকে বাঁচাতে পারল না অসহায় মা। এতটুকু একটা বাচ্চা একা বেঁচে গেল। আর শাহরিয়ার মা-বাবা, বোন-ভাই হারিয়ে একা হয়ে গেল।
সামিয়া এখনও জানে না ওর মা বাবা ভাইয়ের কি অবস্থা। ওরা ঠিকমতোন বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিল কিনা। ধানমন্ডি এলাকায় কেমন হামলা হয়েছে?
শাহরিয়ার বাইরের খবর কেমনে পাব?
সামিয়া আপা, ছোটসাব ছোটবিবিও নাই। মেজসাব মেজবিবির খবর নেও, আবদুল চাচা অস্থির হয়ে বলে কাঁদতে কাঁদতে।
কেমনে খোঁজ নিব চাচা। টেলিফোন ভাঙা, কাজ করছে না। বড় সাবের ঘরে একটা ফোন আছে ঐখান থেকে দেখো। পাশে বড়চাচার ঘরে গিয়ে ঢুকে সবাই। এই ঘরটায় কেউ ছিল না তাই রক্তগঙ্গা বইছে না এই ঘরে। তবু ঘরটার দেয়ালজুড়ে গুলির চিহ্ন। টেলিফোনটা অক্ষত পাওয়া গেল কিন্তু ডায়াল টোন নাই, ডেড। বাড়িভর্তি এতগুলো মৃত মানুষ। রক্তস্রোতের কালচে ধারা ড্রইংরুমে। কলিজার এক একটা টুকরো যেন পড়ে আছে ঘরজুড়ে।

বাইরে নিঃশব্দ নিথর। বাড়িতে কোনো মানুষ আছে বলে মনে হয় না। রাস্তাঘাট একদম ফাঁকা। গতকালও মুহুর্মুহু অনেক মানুষ মিছিল করছিল। জয় বাংলা ধ্বনি লাঠিসোটা হাতে মানুষের অস্থির চলাফেরা ছিল। সবুজের মাঝে লাল সূর্য তার মাঝে হলুদ বাংলাদেশের ছবি দেয়া এক নতুন পতাকা মানুষের হাতে হাতে বাড়িতে গাড়িতে পতপত করে উড়ছিল। ওটা নাকি বাংলাদেশের পতাকা। পারভেজ আর সোহেল কয়েকটা নতুন পতাকা এনেছিল কিনে। ফুলে­ারা মেয়েটা একটা পতাকা পাওয়ার জন্য পারভেজের পিছে পিছে ঘুরছিল। কি বুঝেছে কে জানে, একটা পতাকা ওর চাই। সামিয়া ওকে একটা পতাকা দিলে কী খুশি হয়েছিল মেয়েটা। সেই পতাকায় ঢেকে আছে ওর ছোট্ট শরীর। পারুল আপার পায়ের কাছে পড়ে আছে মেয়েটা।
এ বাড়ির মানুষগুলো ছিল বিয়ে বাড়ির আনন্দে ব্যস্ত।

এরই মাঝে দেশের পরিস্থিতির কারণে কোনোরকম বাধা পড়ে কিনা বিয়ের কাজে এই নিয়েও কিছুটা উদ্বিগ্নতা ছিলই। কিন্তু বিয়ের তারিখ অনেকদিন ঠিক হয়ে আছে। বর আমেরিকা থাকে। চলে যাবে বিয়ের দিন পনের পরে। তাই বিয়েটা এরই মধ্যে হয়ে যেতে হবে। কিছুটা উদ্বিগ্নতা কাজ করছিল সবার মনে। বাজারে সব জিনিসের আকাল। লোকে নাকি বেশি বেশি জিনিস কিনে রাখছে, যেকোন সময় যুদ্ধ লেগে যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত সব আয়োজনই হয়েছিল ভালোয় ভালোয়। বাকি ছিল শুধু ছাব্বিশে মার্চ উনিশশো একাত্তর বিয়ের অনুষ্ঠান। কি হয়ে গেল সব একরাতে। পাগলের মতন লাগে সামিয়ার এই শূন্যতা। বুকের ভিতর এতটা হাহাকার-যন্ত্রণা, খালি হয়ে যাওয়ার কষ্ট শুধু মুচড়াচ্ছে। কান্না করার মতন অবস্থাও নাই। বাবুয়া ছোট বাচ্চাটাও যেন কাঁদতে ভুলে গেছে। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকে সামিয়ার দিকে আবার মুখে আঙ্গুল ঢুকিয়ে কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। সামিয়া বাবুয়াকে বুকের মাঝে জড়িয়ে রেখেছে।
বাইরের খবর পাওয়ার কোনো উপায় নাই। কি হয়েছে বা হচ্ছে বোঝার উপায় নাই।
শাহরিয়ার রেডিও ধরে ধীর ভল্যুমে। কোরআন তেলাওয়াত চলছে। একসময় অবাঙালি একজন উর্দু ও ইংরেজিতে জানাল কারফিউ দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কারফিউ চলবে। মার্শাল ল জারি হয়েছে। নিয়মকানুন বলে দিতে লাগল। মার্শাল ল এবং কারফিউর সময় কি করতে হবে আর আইন ভঙ্গ করলে কেমন শাস্তি পেতে হবে বলে যাচ্ছে রুক্ষ কণ্ঠে।
শাহরিয়ার বলল কারফিউ না উঠা পর্যন্ত আমাদের এভাবেই থাকতে হবে। কিচ্ছু করার নাই। কিছু জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখো। বাবুয়ার কাপড়, খাবার দাবার, টাকা-গহনা। সুযোগ পাওয়ামাত্র বেরিয়ে পড়তে হবে। পালাতে হবে ঢাকা ছেড়ে। আবদুল চাচা খাবার এনে দিয়েছে, কিছু খেতে পারলাম না। চারপাশে প্রিয়জনের শব, সমস্ত প্রিয় মানুষের মৃতদেহ তাদের কোনো সৎকার করা যাচ্ছে না। বাবুয়াকে খাইয়ে কোণার দিকে পারুল আপার ঘরে বাবুয়াকে বুকে জড়িয়ে লুকিয়ে থাকলাম নিঃশব্দে। ছেলেটাও কেমন নিস্তেজ হয়ে গেছে। কোথাও কোনো মানুষের সাড়াশব্দ নাই। ঢাকার সব মানুষ কি মেরে ফেলেছে?

শাহরিয়ার আর আবদুল চাচা মিলে বাড়ির পেছনের বাগানে বড় একটা কবর খুঁড়েছিল। আবদুল চাচা জানাজা পড়েছিল সব মানুষের সবাই শামিল ছিলাম। বুকের কষ্ট আর চোখের জলের সাথে সবাইকে কবরে নামিয়ে দিয়ে আমরা কারফিউ ভাঙ্গার অপেক্ষা করছিলাম। গাড়ির ভিতর সব জিনিসপত্র তুলে রাখা হয়েছে, শুকনো খাবারসহ। সুযোগ পাওয়ামাত্র বেরিয়ে পড়ার অপেক্ষা। একটা দিন আর রাত এত লম্বা হতে পারে ধারণা ছিল না।

ভয়ংকর আতংক নিয়ে কাটলো সে এক দিন এক রাত। যেকোন সময় আবার আর্মি এসে আমাদের মেরে ফেলতে পারে। আবার কারফিউর মধ্যেও বাইরে বেরুনো যাবে না। তাহলেও মৃত্যু নিশ্চিত। সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ চলে গেল। টেলিফোনের কানেকশন নাই। ঢাকা শহরকে পঙ্গু করে দিবে মনে হয় সবদিক দিয়ে। রাতভর আবারো গোলাগুলি, বোমা, ঘুমহীন আতংকে, যে কোনো সময় আবার মিলিটারি এসে পড়ার ভয়ে চারজন একত্রে একঘরে নির্ঘুম সকাল হওয়ার অপেক্ষা, কারফিউ উঠার অপেক্ষায় কাটল ছাব্বিশ মার্চ রাত্রি উনিশশো একাত্তর।

ভোরবেলা কিছুটা যেন সরব হলো শহর। মানুষ ছুটছে পোঁটলা-পুঁটলি, বাক্স-পেটরা নিয়ে। কেউ রিকশায়, কেউ হেঁটে, কেউ গাড়িতে, যে ক’জন বেঁচে আছে জীবন ত্রাসে, বেঁচে থাকার আকুতি নিয়ে যেদিকে পারছে ঢাকা ছেড়ে পালাচ্ছে মনে হলো। শাহরিয়ার রেডিও ধরে শুনল কারফিউ তোলা হয়েছে। অমনি গাড়ি নিয়ে আমরা চারজন বেরিয়ে পড়েছিলাম। আবদুল চাচার পথনির্দেশনায় শাহরিয়ার ড্রাইভ করছিল। ধানমন্ডির দিকে কি অবস্থা আমরা জানি না। আমরা ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার জন্য দাউদকান্দির পথ ধরলাম। আবদুল চাচার বাড়ি দাউদকান্দি। সে আমাদের ওখানে নিয়ে যেতে চাইছে। হয়তোবা গ্রামের দিকে আর্মি যায়নি এখনও। আমাদের তেমন কিছু জানা নাই। শাহরিয়ার সেই আঠারো বছর বয়সে দেশের বাইরে চলে গেছে, রাস্তাঘাট তেমন কিছু চিনে না। মা-বাবার সাথে যোগাযোগ হলো না। যতবার ফোন করার চেষ্টা করলাম টেলিফোনে কোনো শব্দ নেই। ওরা কেমন আছে, বেঁচে আছে কিনা কেমনে জানব, কবে জানব কে জানে? ওদের খোঁজ করার জন্য ধানমন্ডির দিকে যাওয়ার সাহস আমাদের হলো না। এখানে আমরা ক’জন ছাড়া সবাই মৃত। ও বাড়িতে তিনজন মানুষ বেঁচে থাকলে পরিস্থিতি শান্ত হলে হয়তো আবার দেখা হবে। সে মুহূর্তে ঢাকার ভিতরের দিকে যাওয়ার মতন মনোবল আমাদের কারো ছিল না।

জানা সব বিষয়গুলো হঠাৎ অজানা হয়ে গেল কেমন করে। একরাতে অনিশ্চয়তার এক জীবনে ঢুকে পড়লাম আমরা।
কোনোদিকে কোনো পথে ছুটে চলছিলাম আমরা, কিছু জানা নাই। মনে আছে ধানমন্ডির দিকে যাওয়া হয়নি। আমরা উল্টা পথে রওনা হলাম। লোকের মুখে যেদিকে মিলিটারি এখনও যায় নাই শুনছি সে পথেই যাচ্ছিলাম। কোথায় মিলিটারি আছে বা নেই, তারা কি করছে কেউ সঠিক কোনো কিছু বলতে পারছিল না। একটাই ধারণা বদ্ধমূল কাজ করছে ওরা আমাদের শেষ করে ফেলবে, সব বাঙালি মেরে ফেলবে।

আমাদের ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার পথে শুধু আগুন ধোঁয়া ভাঙচুর, মৃত মানুষ দেখেছি, মানুষের ভীত-বিহŸল মুখ আতংকগ্রস্ত। পালাচ্ছে সবাই। কে কোথায় যাচ্ছে, কোথায় নিরাপত্তা, কেউ কিছু জানে না। অনেকেই হারিয়েছে আপনজন, হয়েছে আহত। পুড়ে গেছে বাড়িঘর। বিকেলের দিকে পথে অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে আমরা দাউদকান্দি পৌঁছলাম। শরীরে এক-ফোঁটা শক্তি নাই। আবদুল চাচার ঘরে থাকার জায়গা নাই। একটা ভাঙা কুঁড়েঘর। গ্রামের পরিচিত এক বড় গৃহস্থের বাড়িতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিল। ঐ বাড়িতে আমাদের অনেক আদর-যতœ করে রাখল। কয়েক দিনে ও বাড়িতে আরো মানুষ এসে উঠল। ওদের আত্মীয়-অনাত্মীয়। শাহরিয়ার খোঁজ নিয়ে বের করল, এখান থেকে নদী পেরিয়ে বর্ডার ক্রস করে ওপারে চলে যাওয়া যায়। একটা নৌকা ঠিক করে এলো পরদিন আমরা এখান থেকে চলে যাবো তার জন্য। রাতের বেলা মিলিটারি আসার খবর পেয়ে সেই অন্ধকারে কীভাবে, কোনো পথে, কতদূর হেঁটে, কোথায় পৌঁছেছি কিছু জানি না। অপরিচিত মানুষের বাসায় থেকে আবার মিলিটারি এসে পড়ায়। সে বাড়ির লোকসহ গ্রামের লোকের সাথে মাইলের পর মাইল দৌড়ে পালিয়েছি আবারও। রাস্তাঘাট কিছুই চিনি না। মানুষ যে দিকে দৌড়ায় সেদিকেই যাই। অচেনা অজানা মানুষ অনেক আদর করেছে। থাকতে দিয়েছে, খেতে দিয়েছে। এক বাসায় আছি প্রায় দশ দিন, এখনও এদিকটা নিরাপদ। কোনো কিছু জানি না। শুধু ভেসে বেড়াচ্ছি এখান থেকে সেখানে। প্রাণটা যেন হাতের মুঠোয় যে কোনো সময় বেরিয়ে যাবে। ইন্ডিয়া যেতে এখান থেকে আবার উল্টা যেতে হবে কিছুদূর, যে দিকে নদী সে পর্যন্ত। সে সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। ঐদিকটা মিলিটারি নাকি ভীষণভাবে দখল করে রেখেছে, অত্যাচার করছে। জ্বালিয়ে দিচ্ছে গ্রাম। মেরে ফেলছে মানুষ।

বাবুয়া খানিকটা ধকল কাটিয়ে উঠেছে মনে হয়। একটু একটু কথা বলে আজকাল। মাকে খুঁজে গান করে। বাবুয়ার মা ছোটচাচী খুব ভালো গান করত। মার গানের সুর ভাজে ও মনে হয়। শাহরিয়ারের লন্ডন ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে কিন্তু আমরা ছুটে বেড়াচ্ছি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়, প্রায় দেড় মাস। ঢাকার অবস্থা কি, মা-বাবার কোনো খোঁজ জানি না। ঢাকায় ফিরার মতন সাহস পাই না। এখন নাকি আর্মিরা মেয়েদের ধরে নিয়ে অত্যাচার করছে। এটা আরো বুকে কাঁপুনি তুলছে। যেভাবে হোক, আমি ইন্ডিয়ায় চলে যেতে চাচ্ছি। শাহরিয়ারকে বলেছি একটা পথ বের করো, তুমি হয়তো ওখান থেকে লন্ডন চলে যেতে পারবে। শাহরিয়ার মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চায়, ফিরতে চায় না লন্ডন। মা-বাবা ভাইবোন সব হারানোর প্রতিশোধ নিতে চায়। ও একা হলে কোনোভাবে বর্ডার পার হয়ে যেতে পারত। কিন্তু একটা বাচ্চা আর মেয়ে নিয়ে সমস্যায় পড়েছে। আমরা যদি পথ চিনতাম তাহলে প্রথম দিকেই চলে যেতে পারতাম। কিন্তু এখন মিলিটারি সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে চলা ভীষণ মুশকিল। এখানে সন্ধ্যা হলে সবাই ধীর লয়ে রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার শুনে। প্রাণ চঞ্চল করা সব দেশের গান। শিল্পীদের কন্ঠ পরিচিত মনে হয় কিন্তু নাম অন্য, সবাই মনে হয় ছদ্মনাম ব্যবহার করছে। মুক্তিবাহিনী নাকি গঠিত হয়েছে। মানুষরা আশার হাতছানিতে বুক বাঁধে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার।
নিরবচ্ছিন্ন গ্রাম আর রইল না। রাতের অন্ধকারে মিলিটারি গ্রামে চলে এলো, গোলাগুলি আগুন জ্বালানি পুড়ানি মৃত্যু ছারখার অবস্থা। আমরা আবার দৌড়াচ্ছি। বাচ্চা বৃদ্ধ ছেলে বউ মেয়ে অনেক মানুষ একটা ঘরের মাঝে আশ্রয় নিলাম। মাইলের পর মাইল দৌড়ে শরীরে আর শক্তি নাই কারো। অন্ধকারে নিঃশব্দে ঘাপটি মেরে আছি সবাই একটা ঘরের ভিতর অনেক লোক একসাথে। মিলিটারির কনভয়ের শব্দ যেন এদিকে এগিয়ে আসছে। ভোর হওয়ার আগেই আবার আমরা এই আস্তানা ছেড়ে দৌড়াচ্ছি। একসময় খেয়াল করলাম আমার কোলে বাবুয়া নাই। শাহরিয়ারের কাছেও না। বাবুয়া বলে চিৎকার করে উঠলাম আমি। আশেপাশের মানুষ হিসহিস করে উঠল, থামো থামো মিলিটারি শুনতে পাবে। আমি পথের ধারে বসে পড়েছি। বুকের ভিতর মুচড়াচ্ছে। বাবুয়াকে কোথায় হারালাম? বাবুয়া একা একা কি করবে? বাবুয়া আমার বাবুয়া, আমার আর বাঁচা লাগবে না। আমি উল্টা পথে দৌড় দেই। শাহরিয়ার আমাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে দৌঁড়াচ্ছে। পেছনে মিলিটারির ট্রাকের শব্দ, গোলাগুলি, আগুন। আমাকে টেনে নিয়ে এভাবে আর হাঁটা সম্ভব হচ্ছিল না। সব লোক এগিয়ে যাচ্ছে। শাহরিয়ার আমাকে নিয়ে রাস্তা থেকে নেমে মাঠের মাঝ দিয়ে দৌড়ে একটা ঝোপের ভিতর লুকিয়ে থাকল। মিলিটারি ট্রাকগুলো আমাদের পার হয়ে চলে গেলে মাঠের ভিতর হেঁটে অচেনা এক বাড়ির ভিতর এসে আমরা উঠলাম। বাড়িতে কেউ নেই, গ্রামে কেউ নেই। কোথাও কোথাও আগুন জ্বলছে। আমরা ওখানে লুকিয়ে থাকলাম। খানিক পরে শুনলাম অনেক গোলাগুলির শব্দ, চিৎকার কান্না। হয়তো আমাদের সাথের মানুষ, বাড়িঘর ছেড়ে যারা প্রাণ হাতে দৌড়াচ্ছিল তাদের পেয়ে গেছে মিলিটারির ট্রাক। মেরে ফেলেছে সবাইকে। শাহরিয়ার আমাকে এখানে রেখে আবার ফিরে গেল যে দিক থেকে আমরা এসেছিলাম সে দিকে, বাবুয়াকে খুঁজতে। বলে গেল এ জায়গাটা হয়তো নিরাপদ। কারণ এখানে অ্যাকশন করে চলে গেছে মিলিটারি, তাই চট করে আবার এখানে হয়তো আসবে না। অন্ধকারে একাকী এক গ্রামে আমি শাহরিয়ারের অপেক্ষা করি। একদিন দু’দিন তিন দিন, ও আর আসে না। বাবুয়ার কি হয়েছে, শাহরিয়ার কি আর ফিরে আসবে না? ও কি বেঁচে আছে? ওকি পথ হারিয়ে ফেলেছে? আমি আর ভাবতে পারি না। এখান থেকে বেরিয়ে কোনো দিকে কোথায় যাবো বুঝে উঠতে পারি না। খাওয়া নাই, ঘুম নাই। আতংকগ্রস্ত এক মানুষ ঘরের এক কোণে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকি─এভাবেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। শাহরিয়ারের অপেক্ষা করতে করতে দরজাও বন্ধ করি নাই।

একটু শব্দে ধড়মড় করে উঠে বসি। বুকের ভিতর শুকিয়ে খাঁক, ভয়ে হাতুড়ীর পাড় পড়ছে। উঠে দাঁড়ানোর শক্তি নাই। একসময় তাকিয়ে দেখি আমার সামনে কয়েকজন মানুষ। একজন মহিলা মনে হয় ভীষণ অসুস্থ, পাঁচজন ছেলে বন্দুক হাতে। একজন আমার কাছে এগিয়ে আসে, বলে ভয় পাবেন না। আমি চিনতে পারি এরা মুক্তিযোদ্ধা। দেশের জন্য যুদ্ধ করছে যারা জীবনবাজি রেখে। শাহরিয়ার এদের সাথে তুমি যুদ্ধে যাওয়ার সুযোগ পেতে, তুমি যে কোথায় গেলে? বাবুয়াকে খুঁজে পাওয়া সেও তো এক যুদ্ধ।

আপনি ভালো আছেন তো? ভালো, খুব অবাক লাগে কথাটা। কত কিছু ঘটে গেল। এর মাঝে ভালো থাকতে পারে কেউ এ সময়ে। তবু ভালো আছি আমি তো বেঁচে আছি এখনও।
আমরা এখানে আজ লুকিয়ে থাকব। আমাদের যে পথে যাওয়ার কথা ওপাশে মিলিটারির চেকিং বেড়ে গেছে। রাতের জন্য তাই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

বোন খাওয়ার কিছু আছে? একজন জানতে চায়।

আমি কিছু জানি না। আমি এখানে লুকিয়ে আছি ক’দিন। আমার সঙ্গীরা সব হারিয়ে গেছে। মহিলাটা আর দাঁড়াতে পারছিল না। বসে পড়ল বিছানার উপর। ওরা নিজেরাই খুঁজেপেতে বার করে চিড়া গুড় মুড়ি।

আধো অন্ধকারে ফিসফিস করে কথা বলে, আমি মানুষগুলোর নাম জানি। ইসরাত, কলিম, সাদেকীন, শিবু, হারুন। ওদের দুই বন্ধু সবুর ও পলাশ শহীদ হয়েছে যুদ্ধে। পলাশ হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে হারুন ভীষণ রকম চুপচাপ হয়ে গেছে। এমনিতে ও অনেক বেশি কথা বলে। খুব হাসিখুশি একটা ছেলে। প্রিয়বন্ধু হারানোর শোক ওর স্নায়ুর উপর অত্যন্ত গভীরভাবে পড়েছে মনে হয়। তাই কেমন নীরব হয়ে গেছে। আর কুলসুম বিবিকে ওরা পথে কুড়িয়ে পেয়েছে। পাকিস্তানি বর্বর সেনাদের অত্যাচারে এক বিধ্বস্ত রমণী। চিড়া মুড়ি খেয়ে ওরা এক একজন পাহারা দেয় অন্যরা ঘুমিয়ে নেয়। বিকেলের দিকে হারুনকে ডাকা হয় ওর ডিউটি করার জন্য কিন্তু ও জাগে না। প্রচণ্ড জ্বরে অচেতন হারুন। ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘুমিয়ে উঠে কুলসুম বিবি। বাড়ির পুকুর পাড়ে গিয়ে গোসল করে নিজেকে সাফ করে। লতাগুল্ম বেটে নিজের কাটা-ছেঁড়া জায়গাগুলোয় লাগায়। তোরঙ্গ খুলে কাপড় বের করে পরে। ভাঁড়ার ঘেটে চাল ডাল আলু পেঁয়াজ বের করে রান্না করতে বসে যেন ওর নিজের বাড়ি। ছেলেরা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেÑমাগো অনেকদিন পর ভালো খেলাম। মানুষের সঙ্গ পেয়ে আমি খানিক চাঙ্গা হয়ে উঠি। কুলসুম বিবি চাল নরম করে জাউ ভাত রান্না করে হারুনের জন্য। বালতিতে কাপড় ভিজিয়ে গা মুছিয়ে দেয় ওর জ্বর সারাতে বারে বারে। মুখে তুলে খাওয়ায় রান্না করা জাউ ভাত। ইসরাত ও শিবু আশেপাশে দেখে খবর নিয়ে আসে সন্ধ্যার মধ্যে। আজ রাতেই ওদের চলে যেতে হবে এ জায়গা ছেড়ে। নয়তো অসুবিধা হতে পারে। হারুনের জ্ঞান ফিরছে না। ও আবার অচেতন হয়ে গেছে। নদী এখান থেকে বেশ দূরে। নৌকা পর্যন্ত ওকে নেয়া সম্ভব হবে কি করে এই নিয়ে ওরা জল্পনা-কল্পনা করছে। আমি বললাম, ও থাক আমি দেখাশোনা করব। সাদেকীন অবাক চোখে তাকায় আমার দিকে। ব্যাপারটা খুব রিসকি হয়ে যাবে। ওকে টেনে নিতে গিয়ে আপনাদের সবার উপর রিস্ক এলে সেটাও কি ভালো হবে, আপনাদের তো আরো যুদ্ধ করতে হবে, তাই না? দু’জন মানুষ কোনো রকমে লুকিয়ে থাকব আমরা।

ইসরাত বলে, আমরা দু-তিন দিনের মধ্যে আরো বড় দল নিয়ে ভিতরের দিকের মিলিটারিদের অ্যাটাক করতে আসব, ওদের শেষ করে আপনাদের নিয়ে যাবো। আশা করি হারুন এর মধ্যে সেরে উঠবে। আপনার ভাইও ফিরে আসবেন।
কুলসুম বিবিকে ওরা আমাদের সাথে রেখে যেতে চায় কিন্তু সে ওদের সাথে চলে যায়।

এক মুহূর্তে ছায়াচিত্র হেঁটে যায় সামিয়ার মনে। কত মানুষের মুখ চেনা-অচেনা। কাছের মানুষের চেয়ে অচেনা মানুষের মাঝে কাটছে সামিয়ার সময়। আপনজনরা কে কোথায় গেল? বাবুয়াকে খুঁজে পেলো কি শাহরিয়ার? আজো ফিরে এলো না। বুকের ভিতর খিল ধরে থাকে কষ্ট কান্নার এক ফাঁকা অনুভূতি। মা বাবা সাব্বির তোমরা সবাই কেমন আছো? গ্রামে, গঞ্জে, শহরে মানুষের সাজানো সংসার এক নিমিষে ছারখার হয়ে যাচ্ছে দেখে সামিয়া আর কাঁদতে পারে না শোকে, চোখ জ্বলে প্রতিহিংসায়। নরম মায়াময় হাসিখুশি সামিয়া যেন পাথরমূর্তি। পাকিস্তানিদের জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিতে ওর বুক আর এতটুকু কাঁপবে না।

টরন্টো, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent