রবিবার - মে ১৯ - ২০২৪

যখন পিটি উষা

পিটি উষা

দু’বছর আগে কলকাতা সাফ গেমস কভার করার পর এবার আমার ট্যুর পড়লো দিলি­। এ্যাথলেটিক্সে এশিয়ার সেরা মিট এশিয়ান ট্র্যাক এন্ড ফিল্ড। আর তারই অষ্টম আয়োজন দিলি­তে। জহরলাল নেহেরুর জন্মদিন ১৪ নভেম্বর দিলি­র জহরলাল নেহেরু স্টেডিয়ামে শুরু হয় এই এশিয়ান ট্র্যাক। আর ছয় দিন ব্যাপী এ মিট শেষ হয় ১৯ নভেম্বর প্রয়াত প্রধানমন্ত্রি ইন্দিরা গান্ধীর জন্মদিনে। সুরেশ কালমাদি তখন ইন্ডিয়ান এ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট। অমায়িক ভদ্রলোক। কলকাতা সাফে তাঁর সাথে প্রথম পরিচয়। আর পরিচয়ের পর তাঁর ওপর নেয়া একটি সাক্ষাতকারও ছেপেছিলাম বাংলাদেশের পত্রিকায়। মূলত: তাঁর আমন্ত্রনেই দিলি­র এই ট্র্যাক এন্ড ফিল্ড কভার করতে যাওয়া। পাশাপাশি, অনুরোধও ছিলো বাংলাদেশ এ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের। বিশেষ করে ফেডারেশন কর্মকর্তা ফারুকুল ইসলাম, যিনি ছিলেন এ্যাথলেটদের সুখ-দু:খের সাথী। এ্যাথলেটিক্স আর এ্যাথলেটদের নিয়ে তাঁর সার্বক্ষণিক ভাবনা সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। আমারও অনেক শ্রদ্ধেয়, ক্রীড়াঙ্গনের প্রিয় মানুষদের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ফারুক ভাইয়ের বিশেষ অনুরোধে সিদ্ধান্ত নিলাম দিলি­ যাবো। কভার করবো এশিয়ান ট্র্যাক এন্ড ফিল্ড।
যে কথা, সে কাজ। ১২ নভেম্বর ১৯৮৯, বাংলাদেশ দল রওয়ানা হলো দিলি­র উদ্দেশ্যে। দলের সাথে সঙ্গী হলাম আমিও। সকালে ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছাতেই দেখা মিললো বাংলাদেশ দলের বিশাল বহর। আগে জানা ছিলো না এতো বড়ো বহরের কথা। ঢাকার কাছেই দিলি­ বলে এথলেটিক্সের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকেই নিজ খরচে সফরসঙ্গী হয়েছেন বাংলাদেশ এ্যাথলেটিক্স দলের সঙ্গে। অফিসিয়াল ডেলিগেটদের মধ্যে ছিলেন ফারুকুল ইসলাম (ম্যানেজার), অরুণ চন্দ্র চাকমা (কোচ), এবং এ্যাথলেট শাহ আলম, শাহান উদ্দিন, মিলজার হোসেন, ওয়াজিউর রহমান ও ফিরোজা বেগম। সাংবাদিক হিসেবে একমাত্র আমি। আর আন-অফিসিয়াল ডেলিগেট হিসেবে যাচ্ছেন ক্রীড়াঙ্গনের ‘কমন দুলাভাই’ হিসেবে পরিচিত প্রবীন ক্রীড়া লেখক কাজী শামসুল ইসলাম, এ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট আলতাফ হোসেন, ট্রেজারার জাহাঙ্গীর ফয়েজ, ঢাকা স্টেডিয়ামের প্রশাসক ও সাবেক এ্যাথলেট ইয়াহিয়া আহমেদ, এ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াদুদ, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের বাজেট অফিসার বদরউদ্দিন আহমেদ, এ্যাথলেটিক্স জাজ ইকবাল নবী এবং সাবেক এথলেট ও পুলিশের ডিএসপি এইচ.এম. মলি­ক। প্রত্যেকের সাথেই আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ও সখ্যতা থাকায় রোড টু দিলি­ ছিলো বেশ উপভোগ্যময়।
ঢাকা থেকে বাংলাদেশ বিমানে কলকাতা যাবার পর সেদিন এ্যাথলেটিক্স দল ট্রেনে চেপে রওয়ানা হলো দিলি­ অভিমুখে। আমি থেকে গেলাম কলকাতায়। কলকাতা দমদম বিমানবন্দরেই চোখে পড়লো সেখানকার দৈনিক বর্তমান। প্রথম পাতার ‘ব্যানার হেডিং’ দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো! খেলাধুলার সংবাদ নিয়ে এমন শিরোনামও হয় কলকাতার দৈনিকে? বাংলাদেশের দৈনিকগুলোতে ক্রীড়াবিদদের এমন ন্যাংটা করে সংবাদ ছাপা হয় না। বর্তমান শিরোনাম করেছে: ‘কোচ নাম্বিয়ার সারারাত উষার ঘরে কি করলেন?’ দু’দিন পরই (১৪ নভেম্বর) এশিয়ান ট্র্যাক এন্ড ফিল্ড। পিটি উষা তখন ভারতের সেরা এ্যাথলেট। কেরালার এ মেয়েটিকে নিয়ে দৈনিক বর্তমান যা লিখেছে তা ঢাকার যে কোনো দৈনিকের তুলনায় অসম্ভব।
সে যাইহোক, পরদিন এয়ার ইন্ডিয়ায় কলকাতা থেকে দিলি­র পথে রওয়ানা। বিমানে ওঠার আগেই ক’জন ভারতীয় সাংবাদিকের সাথে দেখা। তাঁরাও যাচ্ছেন দিলি­র এ মিট কভার করতে। কোলকাতা থেকে দিলি­ পৌঁছাতে যতোটা সময় কেটেছে তার মধ্যে অনেকটা সময়ই ব্যায় করেছি ভারতীয় সোনা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে। বলতে দ্বিধা নেই, ভারতীয় সাংবাদিক বন্ধুরা উষা সম্পর্কে এমন সব মন্তব্য করলেন যা শুনে আমিও অনেকটা নিশ্চিত ছিলাম, পিটি উষা যদি একটি সোনাও জেতে, এ হবে তার জন্য বড়ো আশীর্বাদ। কিন্তু দিলি­ পৌঁছিয়েই ট্র্যাকে উষাকে দেখলাম একেবারে তরতাজা, পাঁচদিনের মিটে ৬টি ইভেন্টে অংশ নিয়ে ৬টি পদক ছিনিয়ে নিলো এই ২৭ বছর বয়সেই। চারটি সোনা ও দুটি রুপো জয়ই নয় সাথে সাথে একটি ইভেন্টে রেকর্ড ভাঙার হ্যাট্রিকও করলেন।
নেহেরু স্টেডিয়ামের ৫০ হাজার দর্শক আনন্দে নেচেছেন উষার কৃতিত্বে। অথচ মিট শুরুর দিনও দর্শকদের উপেক্ষার কথা সম্ভবত উষাও ভুলে গিয়েছিলেন। মাঠের মধ্যে উষার সাথে ছবি তোলার জন্য তখন চীনা, জাপানী এ্যাথলেটদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে। ঠিক তখনই দেখলাম উষার কোচ নাম্বিয়ার ভিআইপি ব্লকের এক কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আনন্দে চোখ মুছছেন। কাছে গিয়ে অভিনন্দন জানিয়ে জানতে চাইলাম উষার এই চমকপ্রদ সাফল্যের নেপথ্যের কারণ। নাম্বিয়ার গদগদ হয়ে এক নি:শ্বাসে বলে গেলেন, ভারতীয় কাগজগুলো অহেতুক উষাকে নিয়ে বিভ্রান্তির খবর পরিবেশন করেছে, উষাকে অনেক নীচে নামানোর ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু নিজ চোখে দেখলেন তো উষা ফুরিয়ে যায়নি। উষা যদি এখানে ৬টি ইভেন্টের পরিবর্তে দুটি ইভেন্টে নামতো, তাহলে চি চেং-এর রেকর্ড ভেঙে দিতে পারতো। ওর পক্ষে অসম্ভব ছিলো না। সত্তর সালে ১০০ ও ২০০ মিটারে চি চেং যে রেকর্ড গড়েছিলেন যথাক্রমে ১১.২২ সে: ও ২২.৬২ সে: তা ১৯ বছর পরও অক্ষত রয়ে গেলো।
নাম্বিয়ার সাথে কথা শেষ করেই উষার দিকে ছুটে গেলাম। ততোক্ষণে উষা এই মিটে সেরা এ্যাথলেটের পুরস্কারটি পেয়ে গেছেন। আমাকে দেখে দৌড়ে এলেন। এর আগেও দ’ুবার উষার সাথে কথা বলেছিলাম। অভিনন্দন জানিয়ে তাঁর পারফরমেন্স সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, দেখুন আপনি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন আমার সম্পর্কে যে ধারণা নিয়ে তা নিশ্চয়ই আজকে পাল্টে গেলো। আসলে আমাদের কাগজগুলো আমাকে নিয়ে উদ্ভট সব কল্প-কাহিনী ফেঁদে আমাকে দেশে-বিদেশে শুভাকাঙ্খীদের কাছে খাঁটো করেছে। আমি এবার তাদের সময়োচিত জবাব দিয়ে দিলাম। এবার তো আর কেউ লিখতে পারবে না উষা বুড়িয়ে গেছে বা ফুড়িয়ে গেছে।
উষার সাথে আরো কিছুটা কথা হলো। ওর অনুশীলন, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে। উষার সাথে কথা শেষ করতেই খানিকটা দূরে বসা চি চেং কে দেখলাম ভারতীয় এক সাংবাদিকের সাথে কথা বলছে। এগিয়ে গিয়ে পরিচয় দিলাম। চমৎকার ইংরেজি বলেন। চি চেং-এর কাছে উষা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে চীনা-তাইপের প্রাক্তন এ্যাথলেট, সদা হাস্যোজ্জ্বল চি চেং বললেন, আমি খুশি, এবারও আমার রেকর্ড কেউ ভাংতে পারলো না। তবে আমার বিশ্বাস একদিন না একদিন উষা পারবে। আগেও বলেছি, এখনো বলছি উষার মধ্যে সে স্পিরিট আছে।
আর এ মিটে বাংলাদেশের এ্যাথলেটদের ব্যর্থতার কথা না হয় নাই বললাম! একে একে হিটেই সবাই ছিটকে পড়েছেন। তাও আবার নিজ নিজ হিটে সর্বশেষ স্থান! অথচ মায়ানমারের মতো দেশ প্রথমবারের মতো অংশ নিয়ে মহিলাদের ১৫০০ মিটারে তাঁদের সেরা এ্যাথলেট সিন সিন সোনা ছিনিয়ে নিলেন। এমনকি য্দ্ধু বিধ্বস্ত দেশ প্যালেস্টাইন, যাদের নেই চাল, নেই চুলো তাঁরাও এই মিট থেকে একটি ব্রোঞ্জ পদক গলায় ঝুলিয়ে দেশে ফেরে। আর আমরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম।
এক পর্যায়ে এমন হয়েছিলো যে, প্রেস বক্সে আর বসতেও ইচ্ছে করতো না। কারণ কোনো ইভেন্ট শুরু হওয়ার আগে বিদেশী সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করতেন, দাদা আপনাদের এ্যাথলেট কোন্ লেনে? দৌড় শেষ হতেই আবার জিজ্ঞেস করতো, দাদা আপানাদের এ্যাথলেট কয় নম্বর স্থান পেলো? সে সময় কখনো আমাকে বলতে হয়েছে সব শেষের স্থান, নয়তো বা সব শেষের আগের স্থান। কেউ কেউ একটু হাসতেন, কেউ আবার সান্ত্বনা দিতেন যা আরো বেশী অসহ্য মনে হতো।

মন্ট্রিয়ল, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent