বৃহস্পতিবার - মে ৯ - ২০২৪

এক সপ্তাহ বাদে

ছবিআনা পিলজার

কয়দিন ধরেই মনে হচ্ছিল সকাল-রাতের ম্যাটফরমিনের ডোজটা কমিয়ে আনা দরকার, বিশেষ করে সারাদিনে যেখানে কোনো কার্ব খাওয়া হচ্ছে না, সেখানে সকালেরটা বাদ দিতে অসুবিধা হওয়ার কথা না। সোমবার সকাল থেকে ম্যাটফরমিন খাওয়া বাদ দিলাম। শুধু সন্ধ্যায় খাওয়ার পরে ৫০০ মিলিগ্রামের একটা। বুধবারে সন্ধ্যায় সুগার মেপে দেখি ৫.১। বুঝলাম, এবার রাতের ডোজও বাদ দেওয়া যায়। দিয়ে দিলাম। পরে অবশ্য ম্যাটফরমিনকে আবার ফিরিয়ে এনেছি, তবে সেটা ভিন্ন কারণে। যাহোক, ম্যাটফরমিনকে ছেড়ে দিয়ে মনে মনে ঠিক করে রাখলাম, আগামী ১ সপ্তাহ আর সুগার মাপবো না, যা হয় হবে। আসলে ততদিনে ফ্যাটমেটাবলিজম শুরু হয়ে গেছে, সকালে ঘুম ভেঙে আর কিছু খেতে ইচ্ছে করে না, এমনকি বুলেটপ্রæফ কফিও না। আমি রোজা রাখার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ৯ জানুয়ারি ছিল বৃহস্পতিবার। সেদিন থেকে রোজা শুরু করলাম। জলরোজা (ওয়াটার ফাস্টিং) বা আধারোজা (ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং) না, একেবারে ইসলামি রোজা। অর্থাৎ, ভোরবেলা সেহরিতে খেজুর ও পানি খেয়ে সারাদিন না খেয়ে থাকা।

মাঝে অ্যামাজন-এ এমসিটি তেলের অর্ডার দিয়েছিলাম, সেটা চলে আসে বুধবারে। ফলে সেহরির সময় খেজুরের বদলে ২ চামচ এমসিটি তেল আর ১ গøাস পানি। এমসিটি হচ্ছে অভিজাত নারিকেল তেল। অনলাইনে কিছু রিভিউ পড়ে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া গেল, তাতে করে এই তেল খাওয়ার সিদ্ধান্তে আসতে অসুবিধা হলো না। ওজন কমানো, সুগার নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে নানা কাজের কাজি, সাধারণ নারিকেল থেকে অনেকগুণে ভালো, এক্সট্রাভার্জিন অলিভ অয়েলে যে পরিমাণে ক্যালরি থাকে, এটাতে তার চেয়ে ১০ শতাংশ কম। এমনকি, যাদের টাইপ-১ ডায়াবেটিস, তারাও এমসিটি তেলে উপকার পায়।

- Advertisement -

বৃহস্পতিবারে রোজা শুরু করার পেছনে আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল। শুক্রবারে আধাবেলা অফিস, আর রাতে ব্যাডমিন্টন খেলা। দুদিনের মাথায় শরীরের এনার্জি কোথায় অবস্থান করছে সেটার একটা পরীক্ষা হয়ে যাবে। ইফতারিতে ইচ্ছে করে কম খেলাম। খেলতে যাবার সময় সাথে দুটো কলা নিয়ে নিলাম। সাবধানের মার নেই। খেলতে গিয়ে যদি দুর্বল লাগে, তো কলাই ভরসা। দ্রæত এনার্জি দিতে কলার তুলনা হয় না।

জানুয়ারির ২ তারিখে ব্যাডমিন্টন খেলার সময় বাল্যকালের বন্ধু নাসিরকে বলেছিলাম এই নতুন ডায়েট আর শরীরচর্চার কথা। সেদিন রাতে বাসায় ফিরে টেক্সট করে ওকে তালিকাটাও জানিয়েছিলাম। এদিন খেলার সময় জিজ্ঞেস করাতে বলল যে, কয়েকটা বাদাম খেয়ে এসেছে, তার মানে, সেও শুরু করেছে। খেলার সময় নাসির আমার পার্টনার। অপরদিকে রূপম আর দারা ভাই। ৩ টা গেম হওয়ার পরেও আমাদের মধ্যে টায়ার্ড হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। দারা ভাই অবাক! এর আগে টানা ২ গেম খেললে আমাদের মধ্যে কে আগে বসবে তা নিয়ে টানাটানি হতো, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লো প্রেসারের দোহাই দিয়ে আমি বসে পড়তাম। আজ হলটা কী? ২ ঘণ্টার জন্য আমাদের কোর্ট বুকিং দেওয়া। একেকটা গেম উঠতে ১০ থেকে ১৫ মিনিট লাগে, সেই হিসাবে ২ ঘণ্টায় ৯ থেকে ১০ টা গেম খেলা যায়। ৫ জন খেলোয়াড় থাকলে ৩ গেমের পরে প্রত্যেকে একবার করে বিরতি পায়। আজকে পঞ্চম খেলোয়াড় সাব্বির এসেছিল একটু দেরি করে, ততক্ষণে আমাদের ২ গেম হয়ে গেছে। যাহোক, শেষে দারা ভাইকেই বসতে হলো। তারপর রূপম, নাসির এবং সবার শেষে আমি। অর্থাৎ, টানা ৫ গেম খেলার পরে বিরতিতে গেলাম। কিন্তু শরীরে তখন যেন যৌবনের বান ডেকেছে, কোর্টের পাশে বসার জন্য চেয়ার পাতা আছে, বসতে ইচ্ছে করলো না। তার পরিবর্তে কিছুক্ষণ অ্যারোবিক্স করলাম।

ফেরার পথে একই গাড়িতে ৩জন। আমার আর নাসিরের পারফরম্যান্স যে দারা ভাইকে অবাক করেছে সেটা অনুমান করতে অসুবিধা হয় না। কারণ, কথাবার্তায় ঘুরে ফিরে ওই কথাই আসতে থাকলো।

“এত এনার্জি আসে কোত্থেকে?” দারা ভাই খুটিয়ে খুটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। সুযোগ পেয়ে আমিও ধারাভাষ্যকারদের মতো করে যা যা করেছি তার একটা বিবরণী দিয়ে গেলাম। সবশুনে দারা ভাই মন্তব্য করলেন, “এটা তো কিটো ডায়েট।”

আমিও ততোধিক অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, “কিটো!”

: আরে জানো না, এখানে অনেকেই এই কিটো ডায়েড করে ওজন কমিয়েছে। শুনতে পাই, কার্ব বাদ দিতে গিয়ে তারা নাকি প্রোটিনের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু, এটার সাইড এফেক্ট তো মারাত্মক হয়ে যাবে। এত প্রোটিন তো আমাদের কিডনি নিতে পারবে না।

: কিন্তু আমি তো কিটো করছি না। আমার খাবারে প্রোটিন তো কেবল মাছ আর ডিম, সেটাও ২-৩ টুকরোর বেশি না।

: ডিমের কুসুম তো ফ্যাট। ফ্যাট কিন্তু তোমার কোলেস্টরেল বাড়িয়ে দেবে। ডিম কখন খাও?

: দুপুরে। বাটারে ভাজা ৩-৪টা ডিম। আর গতকাল থেকে তো ডিম খাওয়া বন্ধ। কারণ, রোজা।

: রোজা রেখেই খেললে? ইলেকট্রলাইটের কী অবস্থা?

: হিমালয়ান পিংকসল্ট লেবু পানিতে মিশিয়ে এনেছিলাম, বোধ হয় খেয়াল করেননি। আর কলা ছিল। খেলার বিরতিতে কলা খেলাম তো।

: রোজার আগে কী খেতে? ডিমের কথা তো বললে, বিকালে কি না খেয়েই থাকতে?

: বিকালে খিদা লাগলে বাদাম খেতাম, বাটারে ভাজা ওয়ালনাট আর খোসা ছাড়া সাদা আলমন্ড।

: সবই তো ফ্যাট, বাদাম খাওয়া ভালো, তবে বাটারে ভাজার তো কারণ দেখি না। দেখ, বøাড প্রসার ঠিক আছে তো?

: তা আছে। বলা যায়, আগের চেয়ে কমেছে। এখন ১২০-৮০, তবে অসুধ খেয়ে যাচ্ছি। ডায়াবেটিসের অসুধটা ছেড়ে দিয়েছি, প্রেসারেরটা হয়তো ছাড়তে পারবো।

: বল কী?

পরদিন শনিবারে দারা ভাইয়ের বাসায়। এমনিতেই বেড়াতে যাওয়া, কোনো দাওয়াত-টাওয়াত না। এই শহরে যে কয়েকটা বাসায় দাওয়াত ছাড়াই যাওয়া যায়, তার মধ্যে দারা ভাইয়ের বাসা অন্যতম। শিপু ভাবির রান্নার হাত ভালো, মজার মজার সব জিনিস রান্না করেন। আমাকে দেখলেই ওনার চিতই পিঠা ভাজার ইচ্ছে জাগে, কারণ ওই পিঠা আমি খুব মজা করে খাই। বাসায় ঢুকেই শিপু ভাবিকে সাবধান করে দিয়ে আমার বউ বলল, আজকে কোনোভাবেই চিতই পিঠা বানাবেন না। ও ডায়েট করছে, নো কার্ব।

আমি বললাম, আরে ১০ দিন ধরে কার্ব খাচ্ছি না। আজকে খেলে কিছু হবে না।

এ নিয়ে কিছুক্ষণ কথা হলো। শেষে চিতই পিঠা তার মসৃণ শুভ্র রঙ আর তুলতুলে ত্বক নিয়ে চোখের সামনে হাজির, সাথে ডিমের ওমলেট। খেয়ে ফেললাম ১টা ১টা করে ৬ কি ৭টা। সাইজে এগুলো অবশ্য বাংলাদেশের বাড়িতে বানানো ৪ ইঞ্চি ব্যাসের বড়টার মতো না। একটা খোলার মধ্যে অনেকগুলো ভাজা যায়, এমন দেড়ইঞ্চি বর্গসাইজের চিতই পিঠা। তবে, কার্ব হিসেবে ৬-৭টা পিঠা কিন্তু কম না।

সকালে ওজন নিলাম। আজও রোজা। ওজন কমেছে ১২ পাউন্ড। ১১ দিনে ১২ পাউন্ড কম না। প্রথম ৩ দিনের ওজনটা ছিল পানির। কার্ব খাওয়া বন্ধ করলে শরীর তার বাড়তি পানি ধরে রাখে না, সেজন্য শুরুতে এই ডায়াটে ৪-৫ পাউন্ড ওজন কমে যাওয়া খুব স্বাভাবিক ঘটনা। এটা জানতাম। সেজন্য বাড়তি কোনো উচ্ছ¡াস নেই। কিন্তু অতিরিক্ত ৭ পাউন্ড কমে যাওয়া ঘটনা বটে। কারণ, এগুলো চর্বি, সঞ্চিত চর্বি― তারা দেখি ঝরতে শুরু করেছে। আহারে কতদিনের ইচ্ছে! তলপেটের চর্বি কোনোভাবেই ঝরছিল না। এত খেলাধুলো, এত দৌড়ঝাঁপ, কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছিল না। এবার বাছাধন পালাই পালাই করছে।

ইফতারি মানে ডিনার। শাক-সবজির সাথে ওভেনে বেক করা রূপচাঁদা মাছ, তৈলাক্ত। বেক করা মুরগির রান, ২টা। একটু মনে হয় দ্রæতই খাচ্ছিলাম, বউ বলল, “ডাক্তার জাহাঙ্গীর না বলেছে ৭০বার করে চিবিয়ে খেতে।”

: আরে, তুমি হয়তো খেয়াল করে দেখ নাই, ডাক্তার যতবার ৭০ বার বলে, ততবার খালি হাসে আর হাসে। মানে ওটা তার জানা যে কেউ ৭০ বার চিবাবে না। কথার কথা আর কি।

: ঠিক আছে, ৭০ বার না হোক ৪০-৫০ বার চিবাতে অসুবিধা কী? আচ্ছা ট্রাই করো।

আমি চেষ্টা করতে থাকলাম, গুনে গুনে ৪২ বার চিবানোর পরে দেখি মুখের মধ্যে শাক-সবজি তরল হয়ে গেছে। আসলে এটা তো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শেখা যে খাবার চিবিয়ে খেতে হয়। কারণ, আমাদের মুখে যে জারক রস আছে, তাকে যত বেশি করে খাবারে মিশতে পারবো, তত বেশি হজমে সুবিধা হবে। কার্বের একটা অংশ তো মুখেই হজম হয়, তা না হলে ক্ষুদ্রান্তে। যাহোক, মুখের জারক রস তো পাকস্থলি থেকে বের হয় না। যার যা কাজ। কিন্তু সেই জ্ঞান শিকায় তুলে রেখেছি কতদিন ধরে! এখন তো মুখে খাবার দেবার আগেই পেট থেকে টান মেরে তাকে ভেতরে নিয়ে যায়।

ক্যালগেরি, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent