একদিন আরএমও অফিসে একটি টেলিফোন কল পেলাম। অপর প্রান্ত থেকে পরিচয় দিয়ে বলছে-স্যার আপনাকে একটু খুলনায় আসতে হবে আদালতে স্বাক্ষী দিতে। আপনাকে অনেক দিন ধরে আমরা খুজছি।-আমিতো বহাল তবিয়তে আছি অথচ খুজে পায়না? মনে মনে ভাবলাম।-আপনার নামে ওয়ারেন্ট আছে স্যার। -তা এসে ধরে নিয়ে যান।– কি যে বলেন স্যার। পূর্বে এ বিষয়ে কোন কোর্ট অর্ডার পাইনি হাজিরা দেওয়ার। জানিয়ে দিলাম আমি যাবো। এসব আমাদের কাজের মধ্যে পড়ে এবং গুরুত্বপূর্ন। এ মামলা প্রায় নিস্পত্তির অপেক্ষায় শুধু শেষ স্বাক্ষ্য অর্থাৎ আমার স্বাক্ষের প্রয়োজন। তাই প্রস্তুতি নিচ্ছি।
একদিন বিকালে বাসায় শ্বশুর পক্ষের একজন এবং সাথে একজন এলেন। সাথে প্যাকেট ভরা আম। বাসায় আমি কোন মানুষ পচ্ছন্দ করতাম না কিন্তু শ্বশুর পক্ষের লোক বলে কথা। তাই তাদের সামনে এসে বসলাম। কথা একটি বিবাদী পক্ষের উকিল তাদেরকে পাঠিয়েছে শিখিয়ে যে আমি যেন তার শেখানো কথা মতো উত্তর দেই। তাদের কথা শুনলাম এবং তাড়াতাড়ি বিদায় করার জন্য হ্যা সূচক উত্তর দিলাম। তারা চলে গেলেন।
আদালতের কাঠ গড়ায় আমি দাঁড়িয়ে। মাননীয় আদালত একজন প্রবীন । বিবাদীর কৌসুলী আমাকে প্রশ্ন করছেন আর আমি উত্তর দিয়ে যাচ্ছি। পরিস্থিতি দেখে মনে হলো আমার কাছে বিবাদী পক্ষের লোক গিয়েছিলো তা সবাই জানেন। একজন ডায়াবেটিসের রোগীর পায়ে গ্রাম্য বিবাদের সময় অত্যন্ত মর্মান্তিক ভাবে লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয় এবং হাড় ভেঙ্গে চামড়া ফুড়ে বাইরে চলে এসেছিলো। ঐ রোগী আমি ভর্ত্তি করি হাসপাতালে এবং মেডিকেল সনদ দেই। রোগীর পায়ে গ্যাংগ্রীন হওয়ার কারনে তিনি মারা যান আর এই কারনেই কেস এবং আদালতের তলব।
কৌসুলী আমাকে প্রশ্ন করছেন কিন্তু উত্তর তার মন মত হচ্ছেনা। তিনি আমার প্রতি ক্ষিপ্ত হচ্ছেন। তার ধারনা তার মক্কেলদের কাছ থেকে আমি টাকা খেয়েছি অথচ তার পচ্ছন্দ মতো উত্তর দিচ্ছিনা। সে বিভিন্ন রকমের উসকানিমূলক কথা বলছে যেন আমি উত্তেজিত হয়ে তাকে কিছু বলি এবং -Contempt of court’ এর কথা বলে আমাকে ফাসাতে পারে। মাননীয় আদালত আমাকে এটি স্মরণ করিয়ে দিলেন এবং যে কোন উস্কানিতে আমাকে শান্ত থাকতে উপদেশ দিলেন।
শেষ প্রশ্নটি ছিলো-কউ পড়ে গেলে পা ভাঙ্গে? কৌশুলির কাংখিত উত্তর -হ্যা। হ্যা বললেই কেস শেষ এবং একজন মৃত মানুষ বিচার পেলেন না। পড়ে গেলে অনেক ক্ষেত্রে হাত পা ভাঙ্গে । -পড়ে গেলে পা ভাঙ্গে তবে এ ক্ষেত্রে তা হয়নি আমি আদালত কে জানালাম। বিচারপতি একটু মুচকি হাসলেন, ভাবটা এমন-কি হে কি শিখিয়ে আনলি?
বিবাদীর কৌসুলী যার পর নাই ক্ষিপ্ত আমার উপর একং বিভিন্ন আজে বাজে কথা বলছেন আমাকে আঘাত করে। আমি চুপ এবং সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম পরবর্তী প্রশ্নের উত্তরে আমাকে কি বলতে হবে। কৌসুলীর প্রশ্ন এবার -এক কথায় বলতে হবে-হ্যাঁ অথবা না অর্থাৎ পড়ে গেলে পা ভাঙ্গে-হ্যাঁ অথবা না। আমাকে যে ভাবে গাল দিয়েছে তাই উত্তরটা অনেক শক্ত এবং কঠিন ভাবে দিলাম। আবারও প্রশ্ন হ্যা অথবা না।—-না। সব শেষ। সবাই চুপ। সরকার পক্ষের কৌসুলীকে পুরাটা সময় চুপ থাকতে দেখলাম। একজন রাষ্টীয় স্বাক্ষী মেডিকেল এক্সপার্টের পাশে দাঁড়াতে দেখিনি তাকে যখন বিবাদীর কৌসুলী আমাকে বিব্রত করছিলো।
আদালতের বাইরে এলাম। একটু ভয় করছিলো। আশে পাশে বাদী পক্ষের দু একজনকে দেখলাম । তারা আমার কথায় সন্তষ্ট। একজনকে একটা রিকসা ডেকে দিতে বললাম। দ্রুতই আমি সে স্থান ত্যাগ করলাম। এ ঘটনার বেশ কিছু দিন পর পরিচিত একজনের সাথে দেখা হয়েছিলো, দেখা মাত্র তার কথা-স্যার করেছেন কি? আপনার কথায় বিবাদীর সাজা হয়ে গেছে এবং তার সরকারী চাকরীটিও চলে গেছে।
একজন ব্যক্তি তার মৃত্যুর পর সুবিচার পেয়েছেন এটা ভেবে এখনও শান্তি পাই।
ইয়েলোনাইফ, কানাডা