রবিবার - মে ১৯ - ২০২৪

কবি আসাদ চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

কবি আসাদ চৌধুরী

বাংলাদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় কবি আসাদ চৌধুরী ৫ অক্টোবর রাত তিনটার পর কানাডার টরোনটো শহরে মৃত্যু বরন করেছেন। তিনি দীর্ঘদিন যাবত নানা জটিল রোগে ভুগছিলেন। আমি তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং তাঁর শোকার্ত পরিবারের সবাইকে আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি।

আমি ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম। তাই কবি শামসুর রাহমান, কবি আসাদ চৌধুরী এবং কবি নির্মলেন্দু গুনের রাজনৈতিক এবং দেশাত্মবোধক কবিতা আমাকে আকৃষ্ট করত। সেই কারণে কবি আসাদ চৌধুরীর সারা জাগানিয়া তিনটি কবিতা- সত্য ফেরারী, তখন সত্যি মানুষ ছিলাম এবং তোমাদের যা বলার ছিল আমার খুব পছন্দ এবং এই কবিতাগুলো আমাকে অনুপ্রানিত করেছে। এই কবিতা তিনটির পংতিমালা আমাকে ভাবিয়ে তুলত।

- Advertisement -

সত্য ফেরারী
কোথায় পালালো সত্য?
দুধের বোতলে, ভাতের হাঁড়িতে! নেই তো
রেষ্টুরেন্টে, হোটেলে, সেলুনে,
গ্রন্থাগারের গভীর গন্ধে,
টেলিভিশনে বা সিনেমা, বেতারে,
নৌকার খোলে, সাপের ঝাঁপিতে নেই তো।
তখন সত্যি মানুষ ছিলাম
নদীর জলে আগুন ছিল
আগুন ছিল বৃষ্টিতে
আগুন ছিল বীরাঙ্গনার
উদাস-করা দৃষ্টিতে।
আগুন ছিল গানের সুরে
আগুন ছিল কাব্যে,
মরার চোখে আগুন ছিল
এ-কথা কে ভাববে?
তোমাদের যা বলার ছিল
বলছে কি তা বাংলাদেশ ?
শেষ কথাটি সুখের ছিল ?
ঘৃণার ছিল ?
নাকি ক্রোধের,
প্রতিশোধের,
কোনটা ছিল ?
নাকি কোনো সুখের
নাকি মনে তৃপ্তি ছিল
এই যাওয়াটাই সুখের।
তোমরা গেলে, বাতাস যেমন যায়
গভীর নদী যেমন বাঁকা
স্রোতটিকে লুকায়
যেমন পাখির ডানার ঝলক
গগনে মিলায়।
সাঁঝে যখন কোকিল ডাকে
কারনিসে কি ধুসর শাখে
বারুদেরই গন্ধস্মৃতি
ভুবন ফেলে ছেয়ে
ফুলের গন্ধ পরাজিত
স্লোগান আসে ধেয়ে।
তোমার যা বলার ছিল
বলছে কি তা বাংলাদেশ ?

তাঁকে আমার খুব কাছের মানুষ মনে হত। কিন্তু ব্যাক্তিগত ভাবে সাক্ষাৎ বা কোন পরিচয়ের কোন সুযোগ হয়ে উঠে নাই। সেই মহেন্দ্র ক্ষণ এসেছিল ২০১৫ সালে টরোনটোতে। টরোনটো নিবাসী কবি দেলওয়ার এলাহী আমার লেখা আমেরিকায় জাহানারা ইমামের শেষ দিনগুলি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে কবিকে আমন্ত্রণ করেছিলেন। অনুষ্ঠানের পূর্বে এলাহীর বাসায় লাঞ্চের আড্ডা। কবি আসাদ চৌধুরীর সাথে প্রথম সাক্ষাৎ। উষ্ণ আলিঙ্গনে আমাকে স্বাগত জানালেন। আরও উপস্থিত ছিলেন কবি রফিক আজাদ, কবি দিলারা হাফিজ, জাহানারা ইমামের ছেলে সাইফ ইমাম, বিখ্যাত ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন, আমার স্ত্রী ড. জিনাত নবী প্রমুখ। মুহূর্তের মধ্যেই তিনি আমাদেরকে আপন করে নিলেন। মনে হচ্ছিল আমারা জেন তাঁর পূর্ব পরিচিত। তিনি আড্ডাবাজ মানুষ। জমিয়ে তুলেছিলেন।

বিকেলে প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আমার বইয়ের প্রশংসা করে তিনি আমাকে লেখা অব্যাহত রাখতে বললেন। অনুষ্ঠান শেষে কথাশিল্পী সালমা বানীর বাসায় এক জমজমাট আড্ডার আয়োজন করা হয়েছিল। মধ্যরাত পর্যন্ত সে আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন কবি আসাদ চৌধুরী। এই ভাবে শুরু হয়েছিল আমাদের সম্পর্ক যা পরবর্তীতে বন্ধুতে পরিণত হয় বয়সের ব্যবধান সত্যেও। এর পর ঢাকাতে অনেকবার দেখা হয়েছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এবং আড্ডায়। আমার একাধিক বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে তিনি প্রধান আলোচক হিসাবে অংশগ্রহণ করেছেন সশরীরে এবং করনা অতিমারির সময়ে জুমের মাধ্যমে। আমি মূলত মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে লিখি যা তাঁরও প্রিয় বিষয়। তিনি এই বিষয়ে লিখতে আমাকে উৎসাহিত করেছেন।

একবার বাংলা একাডেমীর বই মেলাতে আমাকে নিয়ে সারাদিন স্টলে স্টলে ঘুরেছেন। সবার সাথে পরিচয় করে দিয়েছেন। সেদিন উপলব্ধি করেছিলাম তিনি আমাকে কত স্নেহ করেন, কত ভালবাসেন এবং আমার কত বড় একজন শুভাকাঙ্ক্ষী।

দু বছর পূর্বে ডি সি বইমেলায় দু দিন আমরা একসাথে কাটিয়েছিলাম, আড্ডা দিয়েছিলাম, তাঁর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা শুনেছিলাম, দেখেছিলাম তাঁর প্রতি ভক্তদের ভালবাসা, সেলফি তোলার প্রতিযোগিতা। তিনই সহাস্যে সবাইকে সময় দিয়েছেন, কাওকে নিরাশ করেন নাই।
আসাদ ভাইয়ের মেয়ের জামাই নাদিম ইকবাল ফরিদপুরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা নওফেল এর উপড়ে একটি ডকুমেনটারি নির্মাণ করেছিলেন যা ডি সি বইমেলায় প্রদর্শিত হয়েছিল। আসাদ ভাই আমাকে এই ডকুমেন্টারিটি নিউ ইয়র্কে প্রদর্শনের আয়োজন করতে বলেছিলেন। সেই মোতাবেক আমি সেটা ডি সি বইমেলার এক সপ্তাহ পরে নিউ ইয়র্কে আয়োজন করেছিলাম যাতে ওনাকে টরোনটোতে ফিরে গিয়ে আবার আমেরিকায় না আসতে হয়। ওনাকে এত লম্বা ভ্রমণের ধকল সইতে না হয়। সেই কারণে তিনি টরোন্টোতে ফিরে না গিয়ে আমাদের সাথে ডি সি থেকে নিউ জার্সিতে আমাদের বাসায় এলেন এবং এক সপ্তাহ অবস্থান করেছিলেন। আমাদের সুযোগ হয়েছিল ওনাকে সেবা করার এবং আরও জানার। ওনার সাথে আমাদের এক সপ্তাহ অমূল্য সময় কেটেছিল।

নিউ ইয়র্ক বাংলা বইমেলার সাথে আসাদ ভাইয়ের বিশেষ সম্পর্ক ছিল। ডি সি বইমেলার আগের বছর আমরা ওনাকে নিউ ইয়র্ক বইমেলার উদ্বোধক হিসাবে আমন্ত্রণ করেছিলাম। আমি সে বছর বইমেলার আহ্বায়ক ছিলাম। অসুস্থতার জন্য তিনি টরোনটো থেকে নিউ ইয়র্কে আসতে পারেন নি, কিন্তু ভিডিওয়ের মাধ্যমে মেলা উদ্বোধন করেছিলেন। নিউ ইয়র্ক বইমেলার প্রশংসা করে এটার সাফল্য কামনা করেছিলেন।

নিউ ইয়র্ক বইমেলা প্রতি বছর বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিককে মুক্তধারা-জেএফবি নামে সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করে। এ বছর আমারা কবি আসাদ চৌধুরীকে এ পুরুস্কার প্রধান করেছি। সাধারণত, প্রতিবছর কমিটিতে একাধিক মনোয়ন আসে, এবং ভোটের মাধ্যমে পুরুস্কারপ্রাপ্ত ব্যাক্তি নির্বাচন করা হয়। এবার আমাদের কমিটিতে কোন ভোট ছাড়াই সর্বসন্মতিক্রমে কবি আসাদ চৌধুরীকে ২০২৩ মুক্তধারা-জেএফবি সাহিত্য পুরুস্কার প্রদান করা হয়। তিনি আমাদের পুরুস্কার গ্রহণের সন্মতি দিয়ে আমাদেরকে সন্মানিত করেছেন। কিন্তু দুখের বিষয়, অসুস্থতার জন্যে তিনই সশরীরে নিউ ইয়র্কে আসতে পারেন নি। তাঁর স্ত্রী শাহানারা চৌধুরী এবং কন্যা নুসরাত চৌধুরী নিউ ইয়র্কে এসে বইমেলার মঞ্চে তাঁর পক্ষে পুরুস্কার গ্রহণ করেন। তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে আমি ফোন করেছিলাম। তিনি আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে আমাদেরকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন এবং নিউ ইয়র্ক বইমেলা উত্তরুত্তর সাফল্য কামনা করেছিলেন।

কবিতা লেখার পাশাপাশি তিনি টেলিভিশন উপস্থাপনা ও অনুবাদ করতে পছন্দ করতেন। বিটিভিসহ বেশ কিছু বেসরকারি টেলিভিশনে তিনি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করে জনপ্রিয়তা পান। উপমহাদেশের উর্দু কবিতার অসাধারণ সব অনুবাদ আমরা তার কাছ থেকেই অধিক পরিমাণে পেয়েছি। তিনি অনুবাদ করেছেন প্যালেস্টাইনের নির্বাচিত কবিতা। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ-‘তবক দেয়া পান’, প্রায় দুই ডজন শিশুসাহিত্যে-রাজার নতুন জামা (রূপান্তর), রাজা বাদশার গল্প, কেশবতী রাজকন্যা, সোনার খড়ম, বঙ্গবন্ধু, ইত্যাদি।

যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু পরিষদ, রাশিয়া বঙ্গবন্ধু পরিষদ এবং এন আর বি কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ক এর যৌথ উদ্যোগে আমরা বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধু শিরোনামে একটি উন্নত মানের স্বারক গ্রন্থ প্রকাশ করি। কবি আসাদ চৌধুরী এই স্বারক গ্রন্থের সম্পাদক মণ্ডলীর প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সম্পাদক মণ্ডলীতে আরও ছিলেন আব্দুল গাফফার চৌধুরী (প্রধান উপদেষ্টা), আমি (নির্বাহী সম্পাদক), তমাল পারভেজ (সম্পাদক) এবং ডঃ আমিনুর রহমান সুলতান (সম্পাদক)। এই গ্রন্থে তিনি বঙ্গবন্ধুঃ স্মৃতি অম্লান শিরোনামে এক দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেন যেখানে তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। আমার জানামতে কবি আসাদ চৌধুরী এবং আব্দুল গাফফার চৌধুরী এর এটাই ছিল তাদের জীবদ্দশায় শেষ সম্পদনা কর্ম।

গুণী ও সমৃদ্ধ এই কবি তার লেখালেখির জন্য ১৯৮৭ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০১৩ সালে একুশে পদকসহ আরও অসংখ্য পুরস্কার, পদক ও সম্মাননা।

তিনি আমাদেরকে ছেড়ে নাফেরার দেশে চলে গেলেন। কিন্তু তিনি বেঁচে থাকবেন তার কবিতা ও সৃষ্টিতে অনন্ত কাল। জাতি হারাল এক মহান কবি, আমি হারালাম আমার এক বিশ্বস্ত বন্ধু এবং শুভাকাঙ্ক্ষী।

- Advertisement -

Read More

Recent