সোমবার - মে ২০ - ২০২৪

সিউল আসপু

জীবনের দীর্ঘ রকি রোডে কতো না স্মৃতিই এলোমেলো হয়ে উড়ছে। দেশে, বিদেশে এমনকি এই প্রবাস জীবনেও অনেক স্মৃতি। কোন্টা ধরে লিখবো আর কোন্টা ছেড়ে বলবো! একটা-দুটো তো নয়! শত-সহস্র স্মৃতি। চুরাশিতে ক্রীড়া সাংবাদিকতা দিয়ে লেখালেখির যে জীবন শুরু হয়েছিলো আমার, তা আজ ত্রিশের কোঠায় এসেও থিতু হতে চায় না। কখনো ভালোলাগা-ভালোবাসা, আবার কখানো সখনো তীব্র হতাশা। কিন্তু আজ স্মৃতির বইটা খুলতেই আমার ক্রীড়া সাংবাদিকতা জীবনের সবচে’ সুখকর একটি দিন, একটি ঘটনা আর একটি প্রাপ্তি আমাকে কেনো জানি তাড়া করছে এই গদ্য-গল্পটি লিখতে! তার আগে বলে রাখি, শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বেই ক্রীড়া সাংবাদিকতার মর্যাদাটা একটু অন্যরকম। একদিকে যেমন বিনোদন সম্ভারে পরিপূর্ণ, তেমনি অতিমাত্রায় টেকনিক্যাল। টেকনিক্যাল এ কারণেই যে, নানা খেলার নানা নিয়ম। আর সব নিয়ম জেনেই পাঠকের সামনে এক একটা শব্দ গেঁথে পুরো মাঠের দৃশ্যটা চোখে ভাসাতে হয়, তখন বিষয়টি আর সহজের পর্যায়ে থাকে না। হয়ে দাঁড়ায় কঠিন। হ্যাঁ কঠিনই। কারণ লেখা পড়িয়ে পাঠকের অনুভূতিতে আনতে হয় খেলা বা ম্যাচটির লাইভ দর্শন। অথচ, রাজনৈতিক, অথনৈতিক এমন কি অপরাধ বিষয়ক কোনো লেখা বা রিপোর্টে প্রয়োজন হয় না কোনো নিয়ম জানার রীতি। ফাউল, অফসাইড, কিম্বা লেগ অন, লেগ অফ, লেগ বাই এসবের নেই কোনো উপস্থিতি। সে যাইহোক, ধান ভানতে গিয়ে শিবের গীত বোধ হয় একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে! ফিরে আসি আসল কথায়। বলছিলাম সুখকর একটি দিনের কথা, একটি প্রাপ্তির কথা।
সালটা বিরানব্বই। দ: কোরিয়ার রাজধানী সিউলে এশিয়ান স্পোর্টস প্রেস ইউনিয়নের (অঝচট) কংগ্রেস ও নির্বাচন। সেখানেই বাংলাদেশকে এশিয়ার সদস্যপদ দেয়া হবে কী হবে না নির্ধারণ হবে। আন্তর্জাতিক ফোরামে সদস্যপদ পেতে হলে অনেক বেশী লবিং করতে হয়। যেটা আমি জানতে পেরেছিলাম নব্বইয়ে বেইজিং এশিয়ান গেমস কভার করতে গিয়ে। বাংলাদেশ দলের সাথে সরকারী সাংবাদিক প্রতিনিধি হয়ে বেইজিং এশিয়াড কভার করতে গিয়ে প্রথম জানতে পেরেছিলাম ক্রীড়া সাংবাদিকদেরও রয়েছে এশিয়ান ও ওয়ার্ল্ড জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন। প্রথমেই সদস্যপদ পেতে হবে এশিয়ান সংস্থাটির। তারপর বিশ্ব সংস্থার। বেইজিং এশিয়াতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত এর সবকিছুই ছিলো আমাদের জানার বাইরে। গেমস চলাকালীন কখনো প্রেসবক্সে, কখনো হোটেল লবিতে পরিচয় হয়েছে বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকের সাথে। জানার সুযোগ হয়েছিলো কিভাবে আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশকে অন্তর্ভূক্ত করা যায়। এ বিষয়ে নানা পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন তখনকার এশিয়ান স্পোর্টস প্রেস ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মালয়েশিয়ান সাংবাদিক জর্জ দাস। এশিয়ান গেমস চলাকালীন অনেকগুলো রাত আমরা কথায় কথায় কাটিয়েছি বাংলাদেশের সদস্যপদ পেতে। কোরিয়ান সাংবাদিক পার্ক ক্যাপ চুল তখন এশিয়ান সাংবাদিক সংস্থার (অঝচট) সভাপতি আর জর্জ দাস সাধারণ সম্পাদক। দীর্ঘ দশ বছর তাঁরা ক্ষমতায়। পরবর্তী নির্বাচনে তাঁদের কঠিন প্রতিপক্ষ তখন কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের সাংবাদিকরা। কোরিয়া-মালয়েশিয়া খাঁটি এশিয়ান। মিডিলিস্টরা আমাদের ভাবে মিসকিন দেশ। তাই ওদের সমর্থন আমরা পাবো না ভেবেই আমি বাংলাদেশের পক্ষে লবিং শুরু করলাম ক্ষমতাসীন কোরিয়া-মালয়েশিয়ান প্যানেলে।
বিরানব্বইতে নির্বাচন। একানব্বইতে সিউলে কংগ্রেস। দেশে ফিরে আমাদের সংগঠন বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির (বর্তমানে বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস এসোসিয়েশন, সংক্ষেপে বিএসপিএ) সদস্যপদের বিষয়টি জানালাম। এমন একটি কাজ করে আসায় বাহবা পেলাম অনেকেরই। জর্জ দাসের পরামর্শ মতো এশিয়ান সংস্থাটির সদস্যপদের জন্য আবেদন করলাম। আমি তখন আমাদের সংগঠনের জয়েন্ট সেক্রেটারী (ইন্টারন্যাশনাল)।
হঠাৎ একদিন ঢাকায় অবস্থিত কোরিয়ান এয়ারলাইন্স থেকে আমার কাছে ফোন এলো। তোমার নামে টিকিট এসেছে, পিকআপ করো। খুশীর আতিশয্যে আমি ছুটে গেলাম আমাদের সংগঠনের অফিসে। বিষয়টি জানালাম সবাইকে। কিন্তু বাধ সাধলেন তখনকার সাধারণ সম্পাদক আইনুল হক ও বেশ ক’জন সিনিয়র সাংবাদিক। তড়িঘড়ি করে এক সভা ডাকা হলো। দেয়া হলো আমার সম্পর্কে কিছু অপবাদ। কেউ কেউ তো বলেই ফেললেন সংগঠনের নাম বিক্রি করে আমি নাকি আমার নামে টিকিট এনেছি। আমার বয়স তখন মাত্র ২৩। সিনিয়র সাংবাদিকরা এটা মেনে নিতে পারলেন না। বললেন, তোমার নামে কেনো? সংগঠনকে টিকিট দিবে, আমরা সিলেক্ট করবো কে যাবে! যেমন কথা, তেমন কাজ। কোরিয়াতে লিখিতভাবে জানানো হলো, ব্যক্তি নয়, সংগঠনের নামে টিকিট পাঠাতে! কোরিয়া জবাব দিলো ঠিক এভাবে: আমরা বাংলাদেশ থেকে চিনি একমাত্র কাজী আলম বাবুকে। আমরা নিশ্চিত সে আসলে আমরা বাংলাদেশের ভোটটি পাবো। আর পাবো বলেই বাংলাদেশকে সদস্যপদ দেবার বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করবো। এমন একটা জবাব পাবার পর টনক নড়লো আমাদের সংগঠনের। কিন্তু যাওয়া হলো না আমার কোরিয়ায়।
পরের বছর অর্থাৎ বিরানব্বইয়ে নির্বাচন। এবারো কোরিয়া থেকে আমার ব্যক্তিগত নামে পাঠানো হলো টিকিট। এবার আর কোনো উচ্চবাচ্য নেই। আমাদের সংগঠন ততোক্ষণে বুঝে গেছে আমি না গেলে বাংলাদেশের সদস্যপদ পাওয়া হবে না। অগত্যা, আমি উড়লাম সিউলের পথে। দু’দিন ধরে অনেক লবিং শেষে ২৪ সেপ্টেম্বর এশিয়ান বডির ৩৮তম কংগ্রেসে বিপুল ভোটে বাংলাদেশকে ৩৮তম সদস্যপদ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হলো। একমাত্র বিরোধিতা করলেন, তখনকার এশিয়ান সংস্থাটির ভাইস প্রেসিডেন্ট, ভারতীয় দি স্টেটসম্যান পত্রিকার সাংবাদিক শ্যাম সুন্দর ঘোষ। কিন্তু তাতে কী। ততোক্ষণে বাংলাদেশ জিতে গেছে ৩৭-১ ভোটে। সে যে কী এক অনাবিল শান্তি বলে বোঝানো যাবে না। আজ দেশের ক্রীড়া সাংবাদিকরা প্রতিটি গেমস আর টুর্ণামেন্টে যেভাবে বিদেশের মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তা এই আন্তর্জাতিক সদস্যপদ পাবার মধ্য দিয়েই। ঠিক এখানে এসেই সাংবাদিকতা জীবনে আমার সবচে’ আত্মতৃপ্তি জন্মেছে আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশকে মেলে ধরতে। আর তার সুফল ভোগ করছে এ প্রজন্মের ক্রীড়া সাংবাদিকরা। দিন নেই, রাত নেই, দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তাঁরা আন্তর্জাতিক সব গেমস আর টুর্ণামেন্টগুলোতে।

- Advertisement -

মন্ট্রিয়ল, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent