রবিবার - মে ১৯ - ২০২৪

করোনার মহাযুদ্ধ

শিশুদের জন্যে স্থাপিত ভ্যাকসিন সেন্টার পরিদর্শনে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো

যুদ্ধের রণডঙ্কা বা দামামা যুগে যুগে বেজেছে, সময়সাগরে লুপ্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সুপ্ত অতীতকে নিয়েই যদি আরম্ভ করি, একের পর এক যুদ্ধ ঘটেছে, বিবর্ণ ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে পরিণাম জানা যায়। ধরা যাক ১৯০০ সালে যার জন্ম হয়েছিল, ১৪ বছর বয়সে তিনি দেখেছেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরু। তার বয়স যখন ১৮ বছর দেখলেন যুদ্ধে দুই কোটি মানুষের মৃত্যু, এক কোটি যুদ্ধে অংশ নেয়া সৈনিক আর এক কোটি বেসামরিক ব্যক্তি। আরো দেখেছেন, ছয় কোটি সৈনিকের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ। জেনেছিলেন যুদ্ধে ব্যবহার হয়েছিল আধুনিক সব ম্যাশিনগান, গ্রেনেড, আর্টিলারী, সাবমেরিন, বিষাক্ত গ্যাস ও বোমারু বিমান, এসবের মাঝে সব চাইতে ধ্বংসাত্মক ও প্রাণ সংহারক ছিল আর্টিলারী।
যুদ্ধের রেশ না কাটতেই ১৯১৮ সালে অনতিবিলম্বে শুরু হয় স্প্যানিশ ফ্লুর প্রাদুর্ভাব, বিশ্বের প্রথম প্রচণ্ড সর্বনাশা মহামারী, প্রাণ নিধন হয়েছিল প্রায় ছয় কোটি বা তার ও বেশী, তখন অনেক অনুন্নত দেশে জন্ম মৃত্যুর হিসাবই ছিল না। কেন ঘটেছিল সেই মহামারী, গবেষকদের মনে প্রশ্ন, সেকি বিধ্বংসী গোলাবারুদেরই প্রভাব প্রকৃতির বুকে?
স্প্যানিশ ফ্লু জয় করে তিনি বেঁচে ছিলেন, তাঁর বয়স যখন ২৯ বছর, ওয়াল স্ট্রীট শেয়ার বাজারে ধস নামে, বিলিয়ন ডলার হারিয়ে যায়, শিল্পোন্নত বিশ্বে অর্থনৈতিক পতন প্রগাঢ়ভাবে দুর্ভেদ্য হয়ে পড়ে সুদীর্ঘ সময়। এই বিষাদগ্রস্ততার মাঝে হিটলারের ফ্যাশিবাদী নাজী জার্মানীতে ক্ষমতা দখল করে নেয়। ৩৩ বছর বয়সে তিনি দেখলেন হিটলার চ্যান়্সেলার হিসাবে জার্মানীতে নিয়োগ পেয়েছিলেন। ব্যাপক হত্যাকাণ্ড, ধ্বংসযজ্ঞ লক্ষ্য করেছিলেন।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শুরু হয়েছিল, তখন তিনি ৩৯ বছর বয়সী, অ্যাটম বোমা বিস্ফোরণের মধ্যদিয়ে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটেছিলো। বিশ্ব ইতিহাসে দীর্ঘতম এই সাংঘাতিক বিধ্বংসী যুদ্ধে পাঁচ কোটি নিরীহ প্রাণের অকাল অবসান ঘটেছিল। তার বয়স তখন ৪৫ বছর, দীর্ঘতম এই যুদ্ধ শেষ হয়, তবে আণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তার বিকিরণের ফলে প্রাণহানি অব্যাহত থাকে বছরের পর বছর।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে অ্যাটম বোমার নির্মম প্রয়োগ নিয়ে বিজ্ঞানী ও রাজনীতিবিদদের মনে সংশয় ছিল, এমন কী যুদ্ধ চলাকালে বিজ্ঞানীরা তদানীন্তন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভ্যাল্টকে পত্রলিখে অনুরোধ করেছিল আণবিক মারণাস্ত্র প্রয়োগ না করতে। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত সারা বিশ্বকে সম্পূর্ণরূপে বিস্মিত করে ১২ই এপ্রিল ১৯৪৫ সালে অপ্রত্যাশিত ভাবে রুজভ্যাল্ট মারা যান, বিজ্ঞানীদের পত্র প্রেসিডেন্টের টেবিলে পড়ে থাকে। পরবর্তি প্রেসিডেন্ট হ্যারী ট্রুম্যান বোধ শক্তিহীন ভিন্ন ধাঁচের লোক ছিলেন, কাউর তোয়াক্কা না রেখে ১৯৪৫ সালের ছয়ই আগস্ট কালো দিনে বিশ্ববাসীকে স্তম্ভিত করে জাপানের হিরোশিমাতে অ্যাটম বোমা ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

করোনার টীকা নেয়া শিশুদের সঙ্গে জাস্টিন ট্রুডো

কোরিয়ার যুদ্ধ শুরু হয়েছিল তার বয়স ৫২ বছর, যে যুদ্ধ কবে শেষ হবে জানা নেই বিশ্ববাসীর আজো।
তিনি যখন ৬৪ তে পা দিয়েছিলেন ভিয়েতনাম যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, পরিণাম সকলেরই জানা, সুদীর্ঘ অতীত নয়। তারপর ও জীবদ্দশায় তিনি ছোটখাট আরো অনেক যুদ্ধের সাক্ষী।
এবার ধরুন একটি শিশুর জন্ম হয়েছিল ১৯৮৫ সালে, তার পিতামহ নিশ্চয়ই জানতেন না আজকের আধুনিক জীবন যাত্রার হালচাল। তবে পিতামহ অবশ্যই মৃত্যুর হাত এড়িয়েছেন কয়েকটি যুদ্ধ থেকে কিংবা চরম বিপত্তি ও বিপর্যয় থেকে। আজ আমাদের রয়েছে সকল প্রকার আরাম, স্বাচ্ছন্দ্য বর্তমানের নতুন বিশ্বে, আজকের এই মহামারীর মাঝেও। তবে আমরা অভিযোগ করি মাস্ক পরতে হয় বলে, বাড়ীতে বন্দী থাকতে হয় বলে, যদিও রয়েছে খাদ্য, বিদ্যুৎ, ঠাণ্ডা-গরম জল সরবরাহ, টিভি এবং ইন্টারনেট ইত্যাদি।
পিতামহের আমলে এসব আধুনিকতার অনেক কিছুই ছিল না। তবে মনুষ্যোচিত ভাবে তাদের জীবন ছিল সাধারণ ও আনন্দদায়ক। আমাদের জীবনের সামান্য চালচলনের পরিপ্রেক্ষিত পরিবর্তন, বিস্ময় সৃষ্টি করতে পারে। আমরা সবাই মিলে হাত ধরাধরি পরিবেশ, প্রকৃতিকে স্বস্তি দিতে পারি।
আমরা সীমা লঙ্ঘন করে চলছি, প্রকৃতি ইশারায় জানিয়েছিল গাছ কেটো না, প্লাস্টিক বর্জন কর, গাড়ী চালিয়ে বায়ু, শব্দ দূষণ সীমিত কর। বিশ্ব উষ্ণায়ন বাড়ছে, সুমেরু কুমেরুতে বরফ গলছে, ওজোন স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, কেউ গুরুত্ব দেয় নি। আমাজনের জঙ্গল জ্বলেছে, অস্ট্রেলিয়ায় সব পুড়ে ছাই, কত জীব না মরেছে। আমাদের সকলের জ্ঞান আছে পরোয়া নাই। প্রকৃতি একা বিপদে অসহায়, কেউ হাত বাড়ায় নি উপশমের। তবে প্রকৃতি ধ্বংস হতে পারে না, নিজেকে নিজে রক্ষা করার সময় এসেছিল। তাই আজ ভাইরাস করোনা, যদিও আমরা বলি কোভিড-১৯। আজ ঘরের কোনে বসে ভাবছি হলটা কী, কেউ গাছ কাটছে না, রাস্তায় গাড়ীর সংখ্যা নগণ্য, শব্দ দূষণ বায়ু দূষণ কম। প্রকৃতির আবেদন যখন কেউ শুনেনি, আজ পায়ে বেড়ী পরাতে এই ভাইরাস করোনা। আজ পার্টি নেই, ক্লাব নেই, কোথাও হইহুল্লোড় নেই, করোনা সব কেড়ে নিয়েছে। আজ বুঝতে হবে মানুষে মানুষে বিভাজন করে লাভ হয়না, আজতো জীবন বাঁচাতে দেশে দেশে একে অপরের সাথে হাত ধরাধরি করে করোনাকে সামাল দিচ্ছে।
আজ আমাদের মাঝে আলোচনার প্রধান বিষয় বস্তু কোভিড-১৯, পরিবেশ ও তার গুণগতমান, অর্থনৈতিক হতাশা, সত্যিকার ন্যায়পরায়ণতা।
আমাদের চাহিদা মূলত সীমাহীন, তাই শিল্প-কারখানা বেশী বেশী উৎপাদন করছে, স্পষ্টত উদ্দেশ্যহীন শিল্প বর্জ্য আমাদের স্থল, জল ও বায়ুর মাঝে নেতিবাচক প্রভাবে ফেলছে অবিরত।
পরিবেশ ও প্রকৃতি অপরিমেয় সহানুভূতিশীল, আমরা মানব জাতি মোটেই নয়, ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লু মহামারীর পর প্রকৃতি ধৈর্যশালী হয়ে ১০০ বছরের উপর অপেক্ষা করেছে, তারপর কোভিড-১৯ সংঘটিত হয়েছে। অখণ্ড বিশ্ব এখন অস্থির, মহা-দুর্যোগ মোকাবেলায় আজ মহা-যুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধের মাঝে আমাদের শিক্ষণীয় বহু কিছু।
করোনা ভাইরাস বৈষম্য মূলক আচরণ করেনি, সারা বিশ্বে আঘাত হেনেছে, বিবেচনায় নেয় নি ধর্ম, ভাষা, মানব প্রজাতি, গাত্র বর্ণ ও লিঙ্গ। করোনার পাসপোর্ট লাগেনি যে কোন দেশের বর্ডার অতিক্রম করতে। আমরা কী বার্তা বা শিক্ষা পেতে পারি এখানে?
আমরা দেশে দেশে বিভাজন করি পরিবেশের যত্ন না করে। মানবতাকে ভালোবাসা চাই সকলের কিন্তু কতজন এই বাণী প্রতিপালন করি? আমরা কী সহজ, সরল ও সাদাসিধা জীবন ন্যূনতম চাহিদা নিয়ে চলতে পারি না? আমরাতো প্রাকৃতিক বিশুদ্ধ জল পান না করে শিল্প জাত রাসায়নিক কলুষিত পানীয় পান করতে অভ্যস্ত রয়েছি ।
আমাদের আজ প্রয়োজন সুনিশ্চিতভাবে সচেতন হওয়া এবং কিছুটা বাহুল্য বিসর্জন ও ত্যাগ স্বীকার করা। এই উৎসর্গ পরিবেশ প্রকৃতি সুরক্ষার জন্যেই শুধু নয়, আমাদের নিজেদের সুরক্ষার প্রয়োজনেও বটে।
আমরা একদিন থাকব না, তবে বিশ্বচরাচর বিদ্যমান থাকবে, আমাদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম এখানে বসবাস করবে। তাদের সুরক্ষার জন্য আমাদের কাজ করে যেতে হবে।
আজ অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে, মর্ত লোকে পরিবেষ্টিত জীব সত্তার মাঝে, মানব জাতির অবাঞ্ছিত কর্ম তৎপরতা সব চাইতে অধিকতর ক্ষতিগ্রস্ত করেছে পরিবেশ ও প্রকৃতিকে। এখন মানুষেরই গুরুদায়িত্ব বাস্তব সম্মত গতিপথ নির্ধারণ করা সংশোধনের লক্ষ্যে এবং সংযত হয়ে কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে রাখা যেন আরো অধিকতর ক্ষতি সাধন না হয়।
সব কিছুর মাঝে সত্য এই আমাদের শোধরাতে হবে, প্রকৃতি ঠিক থাকলে সব সমাধান হবে, বিভাজন ভুলে গিয়ে সকলে মিলে মিশে পরিবেশ ঠিক রাখা অনিবার্য। তাছাড়া করোনার মত আরো কত অজানা বিপদ নানা রূপে আসতে থাকবে, মানুষ তা ভাবতেও পারবে না। এখনো সময় আছে বিশ্বকে সবাই নিজের ঘর ভাবতে হবে, মানব জাতি আজব তা না হলে নিজেদের কর্মফল নিজেরাই পাবে কেন? নিজেরা না শোধ্‌রালে আকাশ থেকে কিছু এসে প্রকৃতিকে ঠিক রাখবে না, আমাদেরই রাখতে হবে।

- Advertisement -

টরন্টো, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent