শনিবার - জুলাই ২৭ - ২০২৪

নৌকা ভ্রমন এবং বনভোজন

নৌকা ভ্রমন এবং বনভোজন

গত শনিবার দিন ছিল আমাদের লেক সেন্ট ক্লেয়ারে শান্ত সলিলে ভেসে বেড়ানোর দিন। ভোর না হতেই আমরা নয়টি পরিবারের পচিশ জন মানুষ একসাথে হই পিউচ রিভার মেরিনাতে। মাঝারি সাইজের তিনটি বোটে উঠলাম আমরা সবাই। এর আগে গত শনিবার দিন আমি, জালাল এবং রানা স্পীড বোট চালানোর ট্রেনিং নিয়েছি। রানা আগে থেকেই লাইসেঞ্চধারী চালক, আমি আর জালাল ছিলাম নতুন। তবে আসুবিধা হয়নি একদিনের ট্রেনিংএ ভালই রপ্ত করে ফেললাম। আজ এসে তাই লাইসেন্সও পেলাম হাতে।

নতুন ড্রাইভার হিসাবে এক্সাইটেড ছিলাম অবশ্যই। তবে মনোবল ছিল ভাল। যদিও কিছুটা ভয় হয়ত কাজ করেছিল আমাদের অন্য ভ্রমন সাথীদের মাঝে। বুঝতে পারছি কেউ কেউ মনে মনে হয়ত বলছে, একদনের ট্রেনিং করা ড্রাইভার, কে জানে কি ঘটায়। শেষটায় লেকের ঢান্ডা পানিতে না চুবিয়ে আনে। তবে আমি বুঝাতে চেষ্টা করলাম যে,আজ ১৫ কি.মি. বেগের দক্ষিনা বাতাস। এই বাতাসে হ্রদের পানি খুব শান্ত থাকে। তাই ভয়ের কিছু নেই। আমাদের ট্রেনিং এর দিন ছিল উত্তরের বাতাস। লেক ছিল উত্তাল। তাওতো আমরা ভয় পইনি, চালিয়েছি ভালই। আর আজতো দক্ষিনের বাতাস। হ্রদ অনেকটাই শান্ত। তাই ভয়ের কিছু নেই।

- Advertisement -

আমাদের কথায় লোকজন আশ্বাস পেল বলে মনে হলো। অল্পক্ষন পরই আমাদের বোট রেস্ট্রিক্টেড এরিয়া পাড় হয়ে দ্রুত গতিতে সাঁই সাঁই চলতে শুরু করল। সাথে স্পিড বোটের ব্লু টুথে বাংলা গানের মাতাল ঝংকার। সবাই মনে হল নতুন জীবন পেয়েছে। আমার বোটে, শামিম ভাই- ইরাম ভাবী, চিকু ভাই – অ্যানি ভাবী, রানা এবং আমি আর শাহিন। মিল্টন ভাই এবং রুনা ভাবিও আমাদের বোটের যাত্রী থাকার কথা ছিল। কিন্তু মিল্টন ভাইয়ের হঠাত অসুস্থতার জন্য উনারা আর যুক্ত হতে পারেননি। উন্রা থাকলে আনন্দটা হয়ত আরো বাড়ত। আমি এবং রানা পালাক্রমে ড্রাইভ করতে থাকি। গানের তালে তালে নাচতে থাকে ইরাম ভাবি, অ্যানি ভাবী এবং চিকু ভাই সহ বোটের প্রায় সবাই। অথৈ জলে দ্রুতযান নিয়ে ঘুরে বেড়ানো সে এক আলাদা আনন্দ।

অন্য একটি বোটে ছিল জালাল। চকচকে নতুন দ্রুতগামী বোট সি-ডু সুইচ ক্রুজ ২১ ট্রাইটুন বোট। দেখে মনে হলো চালাচ্ছে হাওয়াই জাহাজ। একটু পর পরই মাঝ লেকের অথৈ পানিতে হাই স্পীডে ডোনাট চক্কর দিচ্ছিল। ওর বোটে ছিল বিপ্লব-সোনিয়া, হিমেল-উর্মি, খাজা, জালাল-মিশু সহ সব তরুন এবং কিশোর সদস্যরা। তারাও ছিল গানের তালে, হ্রদের হিমেল বাতাসে ছন্দময়।

আমাদের তৃতীয় বোটে ছিল কর্মচঞ্চল সাব্বির- শম্পা, আবিদ-অনিতা সহ আরেক উদ্যমী কাফেলা। আমি প্রায় পুরো সময় জুড়ে ফলো কেরেছি এই কাফেলাকে। কারন এতে ছিল “র-ওয়াটার স্পোর্টস” কোম্পেনীর ড্রাইভার। আমাদের তিনটি বোটের নেতৃত্বে ছিল গডফ্রে পেন্টুন ১৮৮০ সি-এক্স বোটটি।

দেখতে দেখতেই প্রায় পৌনে এক ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে আমরা পৌছে যাই পেস আইল্যান্ডে। উইন্ডসরের অদূরে ডেট্রয়েট রিভার এবং সেন্ট ক্লেয়ার হ্রদের মোহনায় জেগে উঠা অনন্য সুন্দর এই দ্বীপ। এক সময়ে এই দ্বীপের চারদিকে ছিল অসংখ্য হোয়াইট ফিশের চারন ক্ষেত্র। তাই হয়ত এর নাম হয়েছে পেস আইল্যান্ড (Peche Island) বা মাছের দ্বীপ। ১৮৬৮ সাথে মাত্র তিনশ ডলারের বিনিময়ে একশ একরের এই দ্বীপটি বিক্রি হয় জনৈক উইলিয়াম গেস্পার হলের নিকট। কিন্তু নিয়তির কি নির্মম পরিহাস, মাত্র ১৩ ডলারের খাজনা না দিতে পেরে হলের বংশধরেরাও এটিকে বিক্রি করে দেয় উইন্ডসরের তৎকালীন প্রভাবশালী ধনাঢ্য হিরাম ওয়াকার পরিবারের কাছে। কথিত আছে হিরাম ওয়াকারের লোকজন নাকি অনেকটা জোড় করেই এটি দখল করে নেয় এবং জর্জ হলের হত দরিদ্র উত্তরাধিকারদের বিতারিত করে এই দ্বীপ থেকে । যেমনটি আজকাল করে বাংলাদেশের ভুমি দস্যুরা। তবে কালের বিবর্তনে এটি আর ওয়াকার ফ্যামিলির হাতে নেই। এই দ্বীপের মালিক হয়েছি আমরা সবাই – মানে সিটি অব উইন্ডসর।
সময় বদল হয়েছে। কালের চাকা ঘুরেছে অনেক।

এখন আমরা বাস করছি ভূ-গোলার্ধের অন্য পিঠে। পালের হাওয়ায় বয়ে চলা নৌকার বদলে চলেছি যন্ত্রচালিত নৌকায়। নেই কচুরী, নেই শাপলা, নেই সেই কুমার ডাঙ্গার শাপলা বিল। আছে শুধু এগার হাজার বছর আগেকার সর্বশেষ বরফ যুগের স্মৃতি চিহ্ন। বিশ্বের সর্ব বৃহৎ সুপেয় পানির জলাধার গ্রেট লেকস, আর আর অচেনা ঢেউ। কখনো উত্তাল, কখনোবা নিরব- ঢেউহীন।

একটি অনন্য নৌকা ভ্রমনের গল্প বলে শেষ করছি।

বত্রিশ বছর আগের কথা।

আমি মাস্টার্স পাশের পর অধ্যপনা শুরু করি কুমিল্লা শহরের অদূরে সাহেবাবাদ ডিগ্রী কলেজে। শহর থেকে বার মাইল দূরের এই কলেজে সচরাচর যেতে হত বাসে কিংবা মোটর সাইকেলে। তবে আষাঢ় শ্রাবনের প্রচন্ড বৃষ্টিতে রাস্তায় পানি উঠে গেলে গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকত। তখনকার বিকল্প ব্যবস্থা ছিল নৌকায় আসা যাওয়া করা। কুমিল্লা রেল স্টেশন থেকে লোকাল ট্রেনে পাড়ি দিতে হত দুই ষ্টেশন পথ। তার পরই নৌকায় বাকি পথ। প্রায় দুই ঘন্টার নৌকা পথ। নৌকা চলত কখনো দাঁড় বেয়ে আবার কখনো গুন টেনে।

অসম্ভব ভাল লাগত বিলের অথৈ পানিতে ভেসে বেড়াতে। আমরা চার পাঁচজন শিক্ষক একসাথে যেতাম কুমিল্লা শহর থেকে। আমাদের নৌকা চলত কখনো সীমাহীন জলাধারের উপর দিয়ে গভীর পানিতে। আবার কখনোবা অল্প পানিতে শাপলা কিংবা পদ্ম বিলের উপর দিয়ে। তখন চাইলেই লাল কিংবা সাদা শাপলা তোলা যেত ইচ্ছে মতো। আমার ভালই লাগত সাপলা তুলতে। রাতের খাবারের ম্যনুতে যুক্ত হতো আরেকটি নতুন পদ। শাপলা ভাজি, সাথে শুকনো মরিচ ভাজা। আজ অবদি সেই স্বাদ লেগে আছে জিহ্বায়।

সে সময়ের নোকা ভ্রমন সঙ্গীদের সবাই ছিলাম প্রায় সমবয়সী এবং আবিবাহিত। আমাদের বংলার এক ম্যাডাম ছিলেন সদ্য বিবাহিত। ঝির ঝির বাতাসে নৌকা যাচ্ছে। দেখা গেল অন্য একটি নৌকা আমাদের অতিক্রম অনেক মাটির হাড়ি – পাতিল নিয়ে। বাংলার ম্যাডাম হঠাত চিৎকার করে উঠলেন – অন্য নৌকাকে আছে আসার জন্য ডাকতে্। বিষয় আর কিছু না একটি নতুন মাটির হাড়ি কিনবেন উনি। শহরে মাটির হাড়িতে রান্না হয়না সাধারনত। তাও কেন এই হাড়ি কেনা। আমার ম্যডামকে খুব কৌতুহল যুক্ত জিজ্ঞাসা। উনি শুধু মুচকি হাসছেন। বললেন বলা যাবে না। পরে জানলাম উনি ছিলেন সন্তান সম্ভাবা। মেয়েরা নাকি এই সময় ঝিকর খেতে খুব পছন করে। মানে পোড়া মাটির টুকরা চাবিয়ে খায়।

আহা! কি অবাক এক পৃথিবী।।

উইন্ডসর, কানাডা।

- Advertisement -

Read More

Recent