রবিবার - মে ১৯ - ২০২৪

এভাবে চলে যাওয়া কি ঠিক!

তাঁর সাথে আমার অসংখ্য স্মৃতি জড়িয়ে আছে এলিফ্যান্ট রোডের বাসায়

খুব ভোরে ঘুম ভাঙার পর আনন্দে ভেসেছিলাম আমার বই হাতে বন্ধুদের ছবি দেখে। সেই আনন্দ বেশীক্ষন থাকেনি ফেসবুক স্ক্রল করতে গিয়ে। চমকে উঠেছি রুবেলভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ পাঠ করে। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে কাজে গিয়েও মন বসেনি। ঘুরে ফিরে নানান স্মৃতি উঁকি দিয়েছে।

রুবেলভাইয়ের সাথে প্রথম দেখা ও পরিচয় সোনারগাঁওয়ে আমাদের বন্ধু বেলায়েতের( Belayet Hossain) বাড়িতে। তখন আমি নাট্যকার, পরিচালক কাজী শাহীদুল ইসলাম, শাহীদ ভাইয়ের ( Kazi Shahidul Islam) সহকারী হিসেবে কাজ করি। সোনারগাঁওয়ে শাহীদভাইয়ের নাটক “যুথির গলার পুঁথি মালতি গলার হার” এর শ্যুটিংয়ের সময়। এই নাটকে আহমেদ রুবেল ভাইয়ের সাথে অভিনয় করেছিলেন অভিনয়শিল্পী দীপা খন্দকার( Deepa Khandakar) , নাজনীন হাসান চুমকি( Naznin Hasan) আপা ও হাসান ফেরদৌস জুয়েল ( Hasan Ferdous Jewel) ভাই। চিত্রগ্রহনে ছিলেন কামরুল হাসান খসরুভাই ( Kamrul H Khosru) ।

- Advertisement -

তিনদিনের শ্যুটিং শেষে আমরা ঢাকায় ফিরে পরেরদিন থেকে পান্থপথে দেলোয়ার ভাইয়ের এডিটিং প্যানেলে নাটক সম্পাদনা শুরু করি। নাটকটি এডিট করেছিলেন এডিটর পিনাকী রায়, পিনাকীদা’ ( Pinaki Roy) । নাটকের একটি দৃশ্যের সাউন্ড খুব লো থাকায় রুবেলভাইয়ের ডাবিং প্রয়োজন ছিল। কিন্ত সেই সময় প্রেত নাটক করে সুপার ডুপার জনপ্রিয় ও ব্যস্ত শিল্পী। রুবেলভাইয়ের অসম্ভব ব্যস্ততার জন্য শিডিউল পাওয়া যাচ্ছিল না। যে নাটকের এডিটিং ৬ শিফটে নেমে গেল, সেই নাটকের ডাবিংয়ের কারণে আটকে থাকল মাসের পর মাস। এই নিয়ে শাহীদভাই প্রচন্ড ক্ষেপেছিলেন রুবেলভাইয়ের ওপর। শেষ পর্যন্ত রুবেলভাই শাহীদভাইয়ের মান ভাঙাতে এক গভীররাতে এসে প্যানেলে ভয়েজ দিয়ে যায়। সেই সময় আমাকে প্রায় দিন রুবেলভাইয়ের শিডিউলের জন্য ফোন দিতে হত। অনেকদিন এলিফ্যান্ট রোডের মুরগীপট্টির বাসায় আমাকে যেতে হয়েছে। সেই বাসায় গেলে দিলখোলা হো হো হা হা হাসি আর গল্পে আড্ডায় দীর্ঘ সময় কাটলেও একঘন্টার জন্য রুবেলভাই সময় বের করতে তিনমাস লাগিয়ে দিয়েছিলেন।

তাঁর সাথে আমার অসংখ্য স্মৃতি জড়িয়ে আছে এলিফ্যান্ট রোডের বাসায়।

২.
আজ থেকে ২২ বছর আগে রুবেলভাইয়ের একটি সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম। তখন আমি নাটকের সহকারীর কাজের পাশাপাশি দৈনিক সংবাদের বিনোদন বিভাগে কাজ করি। আমার বিভাগীয় সম্পাদক কমলেশ রায়,কমলেশ দা’ ( Kamalesh Roy)। তিনি একদিন আমাকে বললেন, রুবেলের সাথে আপনার ভাল সম্পর্ক, ওর একটা বড় ইন্টারভিউ করেন। আমাদের সাপ্তাহিক বিনোদন পাতা ‘জলসা’র জন্য।

আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা। কারণ যতোই সম্পর্ক থাকুক সেই সময় রুবেলভাইকে ছাই দিয়ে ধরা মুশকিল। কি আর করা! বিভাগীয় প্রধানের নির্দেশ বা অনুরোধ তো আর উপেক্ষা করা যায় না। আমি দুই সাপ্তাহ সময় নিয়ে রুবেলভাইয়ের শিডিউল মেলানোর চেস্টা করতে থাকি। আজ না কাল, কাল না পরশু করে করে রুবেলভাইয়ের সাক্ষাতের সময় পাই না।

এদিকে দুই সাপ্তাহ প্রায় শেষের পথে। অফিস হতে তাগাদার পর তাগাদা ।

কি কিছু হল, কবে দিচ্ছেন লেখাটা?

আগামী পরশু, তরশু দিচ্ছি বলে দিন পার করে দেই।

কিন্ত কিছুতেই রুবেলভাইয়ের নাগাল পাই না। প্রায় সময় ফোন বন্ধ। কিংবা শ্যুটিংয়ের জন্য ফোন রিসিভ করেন না।

দুই সাপ্তাহ শেষ হতে চলছে, ইন্টারভিউ রেডি না বলে কমলেশদা’কে দেখলেই আমি সটকে পড়ি। আমার চোখে মুখে রাজ্যের হতাশা। এর আগে শাবনুর, রিয়াজ,জাহিদ হাসান,শাহনূর, শমী কায়সার, অপি করিম,রোকেয়া প্রাচীসহ কত ব্যস্ত শিল্পীদের ইন্টারভিউ নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ করেছি। কিন্ত রুবেলভাইয়ের সময় ঠেকে গেলাম!

দুইদিন পরে পাতা বের হবে, ভাবছি কালকের মধ্যে লেখাটি কিভাবে করব। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে সংবাদ অফিসের নীচে ফুটপাতে চায়ের দোকানে বসে চা,সিগারেট খাই।

হঠাৎ দেখি মুঈদভাই হোন্ডা থেকে নামছেন। তাকে পাকড়াও করে কিছু বলার সু্যোগ না দিয়ে বলি, এলিফ্যান্ট রোড চলেন। রুবেলের বাসায়।

মুঈদভাই তখন দৈনিক সংবাদের বিনোদন বিভাগের ফটোগ্রাফার। যেতে যেতে মুঈদভাই জিগেস করলেন,শিডিউল কি পাইছেন, নাকি হুদাই যাইতেছেন।

মুঈদভাইর কথার উত্তর দেই না।

বিকেলে কক্ষনোই রুবেলভাইয়ের বাসায় থাকার কথা না। মন বলছিল, রুবেলভাইয়ের শ্যুটিং নেই,বাসায় আছেন। কাকতালীয়ভাবে আমি তাকে পেয়ে গিয়েছিলাম। সেইদিন বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তাঁর সাথে আমাদের দীর্ঘ আড্ডা,আলাপচারিতায় অনেক কথা হয়েছিল। সেই আলাপচারিতার একাংশের অর্ধেকেরও কম দুইদিন পরে জলসায় ছাপা হয়েছে।

৩.
রুবেলভাই অসম্ভব শক্তিশালী অভিনয়শিল্পী ছিলেন। ভরাটকন্ঠের অধিকারী দীর্ঘদেহী রুবেলভাই ঢাকা থিয়েটারের হয়ে মঞ্চ কাঁপিয়েছেন। ছোটপর্দায় অসংখ্য ভাল কাজ করেছেন। চলচ্চিত্রেও বেশকিছু কাজ করেছিলেন। এইসব বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য একুশে টেলিভিশনে আমার প্রযোজিত লাইভ অনুষ্ঠানে একবার আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে এসেছিলেন।

রুবেলভাইয়ের সাথে একটি নাটক ছাড়া আর কোন কাজ হয়নি। কিন্ত প্রথম পরিচয়ের দিন হতে তাঁর সাথে চমৎকার সম্পর্ক গড়ে উঠে। মঞ্চ,নাটক,সিনেমা,খেলা, রাজনীতিসহ নানান বিষয়ে আমরা কথা বলতাম। আমি কানাডায় চলে আসার পরও সেই সম্পর্কের চির ধরেনি। সেই সম্পর্কটার আজ আবসান হয়ে গেল!

আহা রুবেলভাই, এভাবে না বলে চলে যাওয়া কি ঠিক হল?

মন্ট্রিয়ল, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent