১৯৯৪ সাল থেকে ২০২২। আঙুলে গুণলে অনেক বছর। অথচ কী নির্ভার বন্ধনে কেটে গেল দীর্ঘ বছর। পেছনে ফিরে তাকালে সেলুলয়েডের ফিতায় ভেসে ওঠা ছবির মতো দেখতে পাই ঢাকার সেন্ট্রাল রোডে ‘যোজন’-এ আপনার প্রথম প্রদর্শনী।
প্রদর্শনীতে আপনার ছবি দেখতে আসা শিল্পী মুর্তজা বশীর। ঝড়ের গতিতে অনেক অনেক কাজ ও দায়িত্ব মাথায় নিয়ে আসা মুনতাসীর মামুন। তার কিছুদিন পরই একটু আগে পিছে আমরা দু’জনেই চলে আসি কানাডায়। প্রকৃতপক্ষে তখন থেকেই ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমাদের জানাজানি। বন্ধুত্ব। মন্ট্রিয়ালের পার্ক এক্সটেনশনের কথা মনে আসলেই মামুন ভাইয়ের মায়ামাখা মুখখানি ভেসে ওঠে দৈবাৎ। কী অসাধারণ কবিতা লিখতেন। কত কত সুন্দর গল্প! আহা মামুন ভাই, তুহিন!
সেই দিনগুলোতে সত্যি বলছি এক অন্যরকম আনন্দ সারাক্ষণ আমাকে মোহিত করে রাখত। এর একটি কারণ ফরাসি ভাষা এবং শহর মন্ট্রিয়াল। এরকম এক মন উচাটন করা সময়েই জানতে পারলাম শিল্পী সৈয়দ ইকবাল কানাডাতে, এমনকি একেবারে মন্ট্রিয়াল শহরে। বাংলা বার্তা নামে একটি পত্রিকা বেরুত, সেই পত্রিকার সম্পাদকই এই খবর দিলেন। জানালেন মামুনুর রশীদ নামে এক কবির সকাশে তাঁকে পাওয়া যাবে। এর মাত্র কয়েকমাস পূর্বেই ঢাকার সেন্ট্রাল রোডের যোজন গ্যালারীতে তাঁর চিত্র প্রদর্শনী দেখে এসেছি। বোধ করি সেটাই ছিল তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী।
সৈয়দ ইকবালকে দেখার আগে তাঁর নাম জানি; আঁকিয়ে হিসেবে, লেখক হিসেবে। তবু তাঁর প্রদর্শনীতে যাওয়া সত্ত্বেও আমাদের পারস্পরিক পরিচয় হয়নি। হওয়ার মতো কোন কারণ ছিল না।শিল্প সাহিত্যের কোন শাখায়ই আমার কোন স্বাক্ষর নেই যে তাঁকে আমার পরিচয় দেওয়া যায়। তবু মন্ট্রিয়াল এসেছেন জেনে তাঁকে স্বাগত জানাতে ইচ্ছে হলো। আরো ইচ্ছে হলো তাঁকে জানাতে, আমি তাঁর প্রদর্শনীতে ছিলাম। ফোন দিয়ে তাই করলাম। ইকবাল ভাই সেদিনই মামুন ভাইয়ের বাসা+অফিসে যেতে বললেন। পরিচয় হলো মামুনুর রশীদ নামের এক দুর্দান্ত প্রকৃত কবির সাথে। মামুন ভাই এককথায় আপাদমস্তক একজন কবি। শুধু রাজনৈতিক চিন্তায় আমাদের সাথে তাঁর অপ্রকাশিত গোলমাল। যদিও মামুন ভাইকে কোনদিন এ বিষয়টা আমি বুঝতে দিইনি। সেই শুরু সৈয়দ ইকবালের সাথে আমার এক মায়াভরা বন্ধনের পথহাঁটা। আজ মনে হলে কৃতজ্ঞতায় চোখ ভিজে যায়।
৯৬ সালে আমি টরন্টো চলে আসি। আর টরন্টোতে এসেই আবিস্কার কবি ‘জ্যোৎস্নার চিত্রকলা’ নামক কাব্যগ্রন্থের কবি ইকবাল হাসানকে। তখন আবিস্কারের আনন্দে আমি বিভোর। কী অদ্ভুত ছোট্ট ভূবনের বাসিন্দা আমরা! এই কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ শিল্পী সৈয়দ ইকবাল আর কবির নাম ইকবাল হাসান। যিনি সৈয়দ ইকবালের দীর্ঘ বছরের পুরনো বন্ধু। [ ইকবাল ভাইয়ের সাথে আমার সময় ক্ষেপণের কথকতা এখানে নয়। সে এক আলাদা অধ্যায়। আপন আনন্দের আলাদা উপাখ্যান। ]
শিল্পী ইকবালও আরো কিছুদিন পর মন্ট্রিয়াল থেকে চলে আসেন এখানে, টরন্টোয়। আবার আমাদের অনিয়মিত আড্ডা হয়। গল্প হয়। একবার আমাকে নিয়ে গেলেন এক কবির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে। কবির বাসায়; কবি সালাউদ্দিন আহমদের সাথে। প্রকৃত শিল্পবোধের এক কবির সাথে পরিচয় হলো। বৈশিষ্ট্যহীন চেহারার সালাউদ্দিন শহীদ কাদরীর কবিতার ভীষণ ভক্ত। শামসুর রাহমান তাঁর অন্তরে জায়গা করে নিয়েছেন। কবিতার জন্য মন ব্যাকুল করা নিরহংকার এই কবি কিছুদিন পর একটি কবিতা গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। প্রথমে কিছুটা শারীরিক কারণে আমাদের সাথে যোগাযোগ কমে গেল। অতঃপর একেবারেই এই কবি চোখের আড়ালে চলে গেলেন। কতদিন তাকে দেখিনা!
যে কোন মানুষের, যে কোন সৃজনশীল কাজ দেখলে সৈয়দ ইকবাল গভীর আন্তরিকতার সাথে আরো পাঁচজনকে জানিয়ে ভীষণ আনন্দিত হোন। আমি খুব কম মানুষের স্বভাবে এই চর্চা দেখেছি। আমাদের বন্ধু সাইফুল ওয়াদুল হেলাল ছবি বানাচ্ছেন আর ইকবাল ভাই উৎসাহ ভরা আনন্দ ও প্রশংসা ছড়িয়ে দিচ্ছেন চারিদিকে। যেন তিনি নিজেই অস্কার বিজয়ের মুকুট মাথায় পড়েছেন।
কোন কিছুতেই আমি তাঁকে প্রবল উচ্ছাস প্রকাশ করতে দেখিনি। কোন কিছুতেই আমি তাঁকে বিচলিত হতেও দেখিনি। এক অসামান্য ভারসাম্যের নিয়ন্ত্রণ তাঁর কথায়, খাদ্যাভ্যাসে, পানে, হাসিতে। এমনকি পরচর্চায়ও। ( ইকবাল ভাই কোনদিনও কাউকেই পরচর্চায় প্ররোচণা দেননি) সর্বোপরি নিজের জীবনে। জীবন শিল্পের এ এক মহৎ মাত্রা। বৈশাখের ঝড়ের সাধ্য কি তাঁর জীবনের আনন্দ আর আত্মছন্দ বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়!
ইকবাল ভাইয়ের কথা মনে হলেই, সেই গানটির কথা মনে পড়ে যায়- মানুষ আমি, আমার কেন পাখির মতো মন / তাইরে নাইরে, তাইরে নাইরে সারাটি জীবন! সত্যি সত্যি এক চঞ্চল পাখি অবচেতনে ইকবাল ভাইয়ের মধ্যে বসবাস করে। যে পাখিটি সারাক্ষণ পুচ্ছকেশ নাচিয়ে অস্থির হয়ে ঘুরে বেড়ায় আপন খেয়ালে। ভাবগম্ভীর কোন অনুষ্ঠানে হোক, কোন বন্ধুর বাড়িতে ঘনিষ্ঠ মানুষজনদের আড্ডায়ই হোক; সহসাই ইকবাল ভাই অস্থির অসহ্যে চঞ্চল পায়চারি শুরু করে দেবেন। কেননা, সেই পাখিটি তাঁকে স্থির থাকতে দেয় না। এই চঞ্চলতা তাঁর স্থির হয়ে বসে থাকার মধ্যেও হতে পারে। আবার নিঃশব্দে পদব্রজে হাঁটায়ও হতে পারে!
আসলে, এই জগতের কোন কিছুর প্রতিই তাঁর কোন মোহ নেই৷ না অর্থ বিত্তের প্রতি। না আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রতাপের প্রতি। এক নির্বিকার, নিস্পৃহ অথচ নিরুপদ্রব এক শিল্পী সত্তার নাম সৈয়দ ইকবাল। তাঁর আঁকা চিত্রমালার যে কোন একটি কাজে মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন এক উড্ডয়মান পাখির রক্তলাল চঞ্চল চঞ্চু! তাঁর আঁকা যে কোন একটি শিল্পকর্মের কাজের বিষয়টি যাই হোক, কী এক স্বয়ম্ভু শক্তির দৈব প্ররোচনায় তাঁর তুলির আঁচড়ে, কিংবা কলমের কালির রেখায় বারংবার এক ডানা জাপটানো লাল ঠোঁটের পাখি এসে জুড়ে বসবেই! অবচেতনভাবেই ইকবাল ভাইয়ের যে কোন কাজে এক কিংবা একাধিক পাখির মনোহর উপস্থিতিই বলে দেয়- শিল্পী সৈয়দ ইকবাল সত্যিই একজন পাখিমানুষ!
যার ভাবনার ডানায় ভর করে নিয়তই উড়াল দেয় মুক্ত আকাশে। ধর্ম থেকে মুক্ত। সম্প্রদায় থেকে মুক্ত। মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ থেকে মুক্ত। এমনকি যে কোন মানুষ সম্পর্কেই নেতিবাচক মন্তব্য করা থেকে মুক্ত। পাখির যেমন মানচিত্র নেই। ভৌগোলিক সীমারেখার সীমাবদ্ধতা নেই। আপনার মনের ভাবনায়ও তাই। পাখির মতো সমস্থ আকাশ ও এই সবুজ গ্রহের পৃথিবী আপনার নিজস্ব।
টরন্টো, কানাডা