রবিবার - এপ্রিল ২৮ - ২০২৪

টরেন্টো-ঢাকা একটানা ১৬ ঘন্টা

আমার অনেক নিকট বন্ধু বান্ধবই আমাকে বলেছেন ভ্রমন শেষে বাংলাদেশ বিমানের এই ভ্রমনের বিস্তারিত লিখতে

করোনার ভয়াল সময় পেরিয়ে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস।

ভাবলাম দেশ থেকে ঘুরে আসলে কেমন হয়। বিশেষকরে বোয়িং এর সর্বশেষ অত্যাধুনিক বিমান ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনার বলে কথা। টরেন্টো-ঢাকা একটানা ১৬ ঘন্টার বিরতিহীন আকাশ ভ্রমন। যেই কথা সেই কাজ। বিমানের সাইটে দেখতে গিয়েই বোকিং কনফার্ম করেছি। আমাদের উইন্ডসরের বাসা থেকে দুপুরের খাবার শেষে নিজের গাড়িতে ড্রাইভ করেই এয়ারপোর্ট পৌঁছাই সন্ধ্যে পৌনে ছয়টার দিকে। চেকিং শেষে বাংলাদেশ বিমানের লাউঞ্জে পৌঁছাতে প্রায় সাতটা বেজে যায়।

- Advertisement -

টরেন্টো এয়ারপোর্টে ফ্রাঞ্চ এয়ার, কে এল এম এবং বাংলাদেশ বিমান মিলে একটি লাউঞ্জের ব্যবস্থা। তাতে আমাদের জন্য ভালই হয়েছে বলে মনে হয়। কানাডিয়ান এবং ইউরোপিয়ান সব ধরনের খাবারই আছে এই লাউঞ্জে। রাতের ডিনার এবং চা খেয়ে খানিক বিশ্রাম। তারপরই প্রতীক্ষিত সেই বিমানে উঠি। রাত নয়টায় বিমান আকাশে উড়ে। বিমানে আমাদের কক্ষে আমরা মাত্র একুশ জন যাত্রি ছিলাম। অবাক ব্যপার এই একুশ জন যাত্রির জন্য বিমানের ক্রু ছিল পাঁচজন। অবিশ্বাস্য হলেও এটাই বাস্তবতা। দিন বদল হয়েছে। এই বলাকা আর সেই বলাকা নেই।

আমার অনেক নিকট বন্ধু বান্ধবই আমাকে বলেছেন ভ্রমন শেষে বাংলাদেশ বিমানের এই ভ্রমনের বিস্তারিত লিখতে। আমার মনে হয় বন্ধুদের অনেকেই বসে আছেন বিমানের সার্ভিস কেমন হয় তা জেনে ভ্রমন করবেন এই প্রত্যাশায়।

আমি বিমানে প্রথম ভ্রমন করি আজ থেকে আটাশ বছর আগে – ১৯৯৪ সালের আগষ্টে। আর সেটিই ছিল আমার জীবনের প্রথম বিমান ভ্রমন। যদিও তখনকার সময়ে নিজের পয়সায় বিমানে চড়ার সাধ থাকলেও সাধ্য ছিলনা। শুধু গল্প শুনতাম। অনেক দিন আগের কথা বলি। আমি তখন কলেজে পড়ি। আমার বড় মামা তখন বিমানে কলিকাতা যেতেন মাঝে মাঝেই। একবার মামার বাড়িতে বড়মামা আর সেজ মামা গল্প করছেন। আমি পাশে দাঁড়িয়ে খুব মন দিয়ে গল্প শুনছি। বিষয়বস্তু বিমানের ভিতরটা কেমন। বড় মামা বললেন, বিমানের ভেতরটা অনেকটা পেঁপের মতো। মনে মনে ভাবতাম আমি যদি একবার পেপে বীজ হতে পারতাম।

অবশেষে ১৯৯৪ আগষ্টে সেই সৌভাগ্য আসে।

অনেকটা অপ্রত্যাশিত ভাবে। জাতিসংঘের বিশটি অঙ্গ সংগঠনের একটি হচ্ছে বিশ্ব আঁতেল সংঘ (ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অরগেনাইজেশন)। সৌভাগ্যক্রমে সেই সংগঠন থেকে আমি বাংলাদেশের পক্ষে আমন্ত্রন পাই। এক সপ্তাহের সেমিনার এবং সেমিনার শেষে জার্মানীর মিউনিখে এক মাসের ট্রেনিং। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিত এই সেমিনারে ১৬৮ টি দেশের প্রতিনিধি যোগ দেয়। বাংলাদেশ থেকে ছিলাম আমি একাই। সেই সম্মেলনে আমিই সম্ভবতঃ ছিলাম সবচেয়ে কম বয়সের সদস্য।
জাতিসংঘের তখনকার নিয়মানুযায়ী ওদের স্পনসর্ড টিকেটে যারা ভ্রমন করবে তাদেরকে যে দেশ থেকে বিমান উড়বে, সে দেশের জাতীয় বিমানেই ফ্লাই করতে হবে। আমাকে তাই পুরো ভ্রমনে পাঁচটি দেশের বিমানে ভ্রমন করতে হয়েছিল।

যা বলছিলাম ১৯৯৪ আগষ্টে বিনে পয়সায় ভ্রমনের কথা। অন্য ভাবে বললে জাতিসংঘের পয়সায় বিমান ভ্রমনের কাহিনী। রাত সাড়ে বারোটায় ফ্লাইট। অফিসের একটি মাইক্রোবাস আমাকে রাত সাড়ে নয়টায় এয়ারপোর্ট নামিয়ে দিয়ে যায়। প্রথমেই ধাক্কা খাই যখন জানতে পারি বিমান এক ঘন্টা দেড়িতে ছাড়বে। এরপরও প্রচন্ড আগ্রহ নিয়ে বিমানে উঠি। সৌভাগ্যক্রমে আমি পেয়েছিলাম উইন্ডো সিট। সারাক্ষন জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকি। কখন বিমান চলতে শুরু করবে। কিভাবে এই বিশালদেহি ডিসি-১০ বিমান আকাশে উড়বে। আমার এই ফ্লাইটি ঢাকা-লন্ডন। পরে কানেক্টিং – বৃটিশ এয়ারে লন্ডন থেকে সুইজারল্যান্ড।

অবাক ব্যপার বিমান আর আকাশে উড়ার নাম নেই।

যদিও এ নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নেই। বিমানে বসে আছি সেই বিশাল ব্যপার। বিমানের পাইলট বারবার দুঃখ প্রকাশ করে ঘোষনা দিচ্ছেন যে উনি মেন্টেনেন্স ইঞ্জিনিয়ারদের ট্যাকনিক্যাল ক্লিয়ারেন্স পাচ্ছেন না, তাই বিলম্ব হচ্ছে। তবে সমস্যা বাঁধল অন্য জায়গায়। মনে হলো আমার মাথার উপর বৃষ্টির ফোটা পড়ছে টুপ টুপ। ভাবছি ব্যপারটি কি? পরে এয়ার হোস্টেজ এসে আবিস্কার করল যে, আমার পেছনের সিটে বসা ইলিশ-প্রেমী লন্ডনগামী সুহৃদ বন্ধু কাঁচা ইলিশ ফ্রোজেন করে মাথার উপরের ক্যারিয়ারে রেখেছেন। আর তা থেকেই বরফ গলে পানি পড়তে শুরু করেছে।

অবশেষে সকল প্রতিক্ষার অবসান ঘটিয়ে দুই ঘন্টা ভূমিতে অপেক্ষার পর বিমানের চাকা ঘুরতে শুরু করে। আমার সারা শরীর আনন্দে কাঁপতে থাকে। একটু পরই বিহঙ্গের মত আকাশে উড়ব। এক সময় জানালায় তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ঢাকার আকাশ ছেড়ে যায় বিমান। পেট তখন খিদায় চো চো করছে। একটু পরই খাবার আসে – খুব মজার খাবার। কেকের মত করে বিমানে বানানো অমলেটের সেই স্বাদ আমি হয়ত কোন দিনই ভুলব না।

আমাদের সে ফ্লাইটে কেন জানিনা কোন পুরুষ ক্রু ছিলনা। সবই অদ্ভূত সুন্দর মহিলা বিমানবালা। এদের আতিথেয়তা ও ছিল মুগ্ধ হওয়ার মতই।

বদল হয়েছে দিন।

আমাদের এবারের বোয়িং ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনারে পুরুষ এবং মহিলা সব ক্রুই ছিল। তবে সবাই ছিল বেশ আন্তরিক এবং হেল্‌পফুল। খবার দাবারের আয়োজন ছিল অসাধারন। মনে হয়েছে ঘরেই আছি। জানালা গুলো বেশ বড় এবং সুইচ টিপে জানালায় রাত এবং দিনের সব রকমের আবহ সৃষ্টি করা যায়। জানালায় কোন সাটার নেই, আর সাটারের দরকারও হয় না।

সময় বয়ে যায় খরস্রোতা নদীর মতো।

বদল হয়েছে দিন। পাক ধরেছে চুলে। ভাজ পড়েছে কপালে।

কিন্তু মন – আছে আগের মতোই। কিংবা আরো বেশী সতেজ। দেশে থাকাকালীন স্বজন, বন্ধুজন এবং অনেক অচেনা লোকের আতিথেয়তা পেয়েছি অনেক। কে জানে জীবনের বাকি সময়টাতে হয়ত কারো কারো ঋণ শোধ করার সূযোগ হবেনা।

এখন আর মা নেই, বাবা নেই। শশুর নেই, শাশুরি নেই।

ঘর নেই, বাড়ী নেই। দেশে গেলে পুরোই মুছাফির জীবন। যেখানে রাত, সেখানেই কাত। যে আদর করে ডাকে তার কাছেই যাই। তাকেই সময় দেই। কেউ হার্ট করেনা, আর করতে চাইলেও গায়ে মাখিনা। জানিনা কেন এত পিছু টান।

আমি জানি আমৃত্যু বয়ে বেড়াব এই টান –

এই যাযাবর জীবন।

- Advertisement -

Read More

Recent