শনিবার - জুলাই ২৭ - ২০২৪

প্রিয়তমা

প্রিয়তমা

নওমিকা তৈরি হয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে এলো। দরজায় তালা দেওয়ার সময় ওর কান্না পাচ্ছিল। ওই ঘরের প্রতিটি আসবাবে, সবগুলো বাসনে ওর যত্ন মিশে আছে, প্রতি কোণায় মায়া পড়ে আছে।

আলমারিটা বিয়ের একদম পরের প্রথম মাসেই কেনা। হঠাৎ বিয়ে হলো ওদের। একদম রাতারাতি। তুমুল তুফান হচ্ছিল সেদিন। উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে সাত নম্বর বিপদ সংকেতের সতর্কবার্তা দেওয়া হচ্ছিল টিভি এবং রেডিওতে। ওকে নিয়ে শাদাব কাজি অফিসে বসেছিল। বিয়ের সাক্ষী ছিল বিপ্লব ও শাকের। ওরা বারবার পায়চারি করছিল আর শাদাবের কানে কানে এসে কথা বলছিল,

- Advertisement -

— ভাই, কাজিরে তুইলা আনি? হালায় করতাছেডা কী? বউয়ের আঁচলের তলায় হান্দাইছে নাকি? হারিকেন আইছে, তুই ব্যাডা মানি মানুষ, জ্ঞানী মানুষ, আল্লাহবিল্লাহ করবি। বউয়ের সাথে হোওনের হুমায় এইটা?

শাদাবের চোখেমুখে উত্তেজনা ছিল না। ও ছিল শান্ত। ওদের কারো কোনো কথারই প্রতিক্রিয়া করছিল না৷ নওমিকার সাথেও একটা কথা বলেনি।

কাজি এসেছিলেন রাত আড়াইটায়! বিয়ের যাবতীয় কাজ শেষ হতে হতে ফজরের আযান পড়ে গিয়েছিল। অত দেরি হওয়ার কথা নয়৷ বিদ্যুৎবিভ্রাট ঘটেছিল। সমস্ত মফস্বল সেই রাতে নিকষ কালো অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল। খোঁজাখুঁজি করে একটা মোমবাতি পাওয়া গেল। সেটার আয়ু ছিল সাত মিনিট। তারপর আবার অপেক্ষা। ভোরের আলো ফুটলে তারপর রেজিস্ট্রারে নামসই করেছিল শাদাব ও নওমিকা। ফজরের নামাজ পড়ে এসে কাজিসাহেব নওমিকাকে বলেছিলেন,

— চারিদিকে যে ঝড় উঠেছে, আপনার জীবনে সেইটা না আসুক আম্মা! বাপ-মায়ের বদদোয়া হইতেছে জালিমের মতোন! আপনারে ছাড়খার না করা পর্যন্ত সেই জালিম বদদোয়া আপনার পিছু ছাড়বে না! আমি আজকে নামাজের শেষ বৈঠকে আমার পরকালের নাজাতের জন্য দোয়া করি নাই, আমার পরিবারের বালা মুছিবতের পানাহ চাই নাই। কেন যেন নামাজের পাটিতে বসে আপনার জন্য আমার হাত দুইটা উঠল গো আম্মা! আল্লাহ যেন আপনারে মাফ করেন, আমি একদম মন থাইকা পরওয়ারদিগারের কাছে দোয়া চাইলাম আম্মা। সৎ থাইকেন আর সাহস রাইখেন। আল্লাহ ভরসা!

ভোরের দিকে নওমিকাকে নিয়ে শাদাব নিজের বাড়ি গিয়েছিল। ওর মা বিশ্রীভাবে চিৎকার করছিলেন, গালাগাল করছিলেন। নওমিকা যাদুটোনা করে তার ছেলের মাথা খেয়েছে বলে অপবাদ দিয়েছিলেন। শেষে অবিশ্রান্ত অভিশাপ!

শাদাবের বাবা এতকিছু করলেন না। সোজা বাইরে যাবার দরজাটা দেখিয়ে দিয়ে গম্ভীর গলায় বলেছিলেন ‘আমি তোমাদের মুখদর্শন করতে চাই না!’

এক কাপড়েই বেরিয়ে এসেছিল শাদাব৷ ওর মুখে রাতজাগা ক্লান্তি, ক্ষুধা আর হতাশার তীব্র ছাপ ছিল। আর ছিল হাহাকার – নওমিকার মাটির চোখে সেটা নওমিকা দেখতে পায়নি। ও ভেবেছিল বাবা-মায়ের সাথে বিচ্ছেদের কষ্ট ছিল সেটা…

শাদাবের চাকরির বয়স ছয় মাসও পেরোয়নি তখন। শুন্য থেকেই শুরু হলো ওদের সংসার, সমস্ত। সকালে হোটেলে নাস্তা করে একটা এক কামরার বাসা ঠিক করে ফেলল ওরা। শাদাব লিস্ট চেয়েছিল ওর কাছে,

— কী কী লাগবে বলো, কিনে আনি।

সংসারের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না নওমিকার।

ও বলেছিল,

— দুটো পাতিল আর একটা বিছানার চাদর!

সেগুলো কিনে দিয়ে খালি মেঝেতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল শাদাব।

নওমিকা চেয়ে চেয়ে দেখছিল ওর নিজের হয়ে যাওয়া মানুষটাকে। মুগ্ধ হয়ে।

ঘুম ভেঙে যেতেই শাদাব বলেছিল,

— ভাত দাও নওমিকা?

নওমিকা হতবিহবল হয়ে বলেছিল,

— ভাত তো নেই!

— রান্না করোনি কেন?

নওমিকা প্রায় কেঁদে ফেলেছিল। প্রিয় মানুষটার ক্ষুধার সময় খাবার না দিতে পারার দু:খে অষ্টাদশীর চোখ ছলছল করে উঠেছিল৷ ও কান্নাভেজা গলায় বলেছিল,

— চাল নেই। চুলা নেই। ভাত হয়নি।

শাদাব হেসে ফেলেছিল,

— দারুণ বললে তো! একেই তবে বলে চালচুলো নেই? মানে চাল কেনার টাকা নেই। চুলোও নেই। ভাববার কথা। চলো আমাদের চালচুলোহীন সংসার ঠিক করি আগে।

দুপুরে কাচ্চি আনিয়ে খেয়ে সারা বিকেল, সারা সন্ধ্যা মিলয়ে কেনাকাটা হলো। একটা স্টিলের খাট কেনা হলো। পাঁচ ফিট বাই সাত ফিট খাট৷ ভেজা ত্যানা দিয়ে মুছে মুছে সেটাকে চকচকে করে রাখত নওমিকা। সেই খাটটাতে অনেকদিন ঘুমাত ওরা। তুশমি হওয়ার আগ পর্যন্ত। তিনজনের জন্য ওই খাটটা ছোটো হয়ে যেত। নওমিকা চেয়েছিল তুশমির জন্য আলাদা বেবিকট কিনে নিতে। কিন্তু শাদাব সেটা পছন্দ করেনি৷ তুশমিকে ছুঁয়ে না ঘুমালে ওর ঘুম আসত না। তাই নতুন করে এই বড়ো কিং সাইজের খাটটা কেনা হয়েছিল। শাদাব পছন্দ করে কিনলেও নওমিকার প্রিয় হয়ে উঠেছিল এই বিছানাটা। টানটান করে চাদর পেতে দিলে কী শান্তি শান্তি অনুভব ছড়িয়ে পড়ত!

আর আলমারিটা কেনা হয়েছিল একদম পরের মাসে বেতনের টাকা হাতে পেয়েই। নওমিকার সংসারের সবচেয়ে দামি আসবাব ওটা। টাকার অংকেও দামি, স্মৃতিতেও দামি। চাকরির বেতনের টাকা বাবা-মাকে দেওয়া লাগত না শাদাবের। সেই টাকা ও জমিয়ে রাখত। ওর বিয়ে নিয়ে অনেক পরিকল্পনা ছিল ওর। সেভাবে তো বিয়েটা হয়নি। সেই বেঁচে যাওয়া টাকা থেকে আলমারিটা কেনা হয়েছিল। অত দাম দিয়ে কেনার কথা ছিল না। কিন্তু ফার্নিচারের দোকানে গিয়ে তিন দরজার এই আলমারিটা নওমিকার খুব পছন্দ হয়ে গিয়েছিল।

শাদাব কিনে দিয়েছিল।

নওমিকার নয় বছরের সংসারের এই একটা আসবাবই ওর পছন্দে কেনা হয়েছিল৷

আর যা কিছু দরকার হয় শাদাব নিজে পছন্দ করে কেনে। ওর পছন্দের সবকিছুই নওমিকার খুব প্রিয়। এই ঘর-বারান্দার সবকিছু নওমিকার খুব প্রিয়।

এইগুলো ফেলে যাওয়া খুব কঠিন। মায়া কাটানো খুব যাতনার৷ প্রতি একটা কোণায় হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিলো ও। চোখের কোণা দিয়ে গড়িয়ে আসতে চাওয়া জলটুকুকেও মুছে নিলো।

শাদাব তুশমিকে নিয়ে নিচে এসেছিল আগেই। গাড়ি বের করছিল। ওদের ড্রাইভার নেই। শাদাবই ড্রাইভ করে। নওমিকার পাশে রাখা ট্রলিব্যাগগুলো দেখে বলল,

— এত কী নিয়েছ? এসব বইবে কে?

নওমিকা ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল।

শাদাব বলল, এসব বইবে কে? একবারও তো বলল না, কতদিনের জন্য যাচ্ছ? এতকিছু নেওয়া লাগবে না!

চিরদিনের জন্য যাচ্ছে সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে নওমিকা। তাই যা যা ওর এই বাসা থেকে নেওয়ার সব গুছিয়ে তিনটে পেটমোটা লাগেজ হয়েছে৷ তুশমির দরকারি কিছু জিনিসে দুটো মাম্মি ব্যাগ ভরেছে আর টোটব্যাগ আছে একটা।

নওমিকা বলল,

— আমিই তুলে দিচ্ছি৷ তোমাকে বইতে হবে না।

ট্রলিগুলো টেনেহিঁচড়ে গাড়ির ডিকির ভেতর ফেলল ও। শাদাব তুশমিকে কোলে নিয়ে গাড়িতে তুলতে ব্যস্ত। এদিকে নওমিকার দিকে তাকানোর ফুরসত নেই। আগে নওমিকা ভাবত শাদাব কন্যা অন্ত:প্রাণ পিতা। এখন মনে হচ্ছে শাদাব যত অবহেলা ওকে করেছে ততই মনোযোগ আর ভালোবাসায় ভরিয়েছে নিজের সন্তানকে।

তুশমিই শাদাবের সবকিছু।

নওমিকা কেউ নয়।

ও কোনোদিন কিছু ছিলই না।

পলিনের ডায়েরিটাকে হাতব্যাগে ভরেছে ও। চিলেকোঠার ঘরে উঁকি দিয়ে কী দেখেছিল সেদিন পলিন, জানাটা জরুরি না এখন আর।

কিন্তু জানতে ইচ্ছে করছে!

ডায়েরির পরের পাতাগুলো ছেঁড়া। সবটা কীভাবে জানবে ও? পুরো ডায়েরিই কি পড়তে হবে?

কে ছিঁড়ল এই পাতাগুলো?

কেন ছিঁড়ল?

আর এতদিন পরে এই ডায়েরিটা কেউ কেন নওমিকাকে পৌঁছে দিলো সেসবও রহস্য হয়ে আছে।

- Advertisement -

Read More

Recent