বৃহস্পতিবার - মে ৯ - ২০২৪

অটোফ্যাজি

ছবি জান সিভেডি

অটোফ্যাজি শব্দটি কয়েকবার বলা হয়ে গেছে। এখন একে একটু ব্যাখ্যা না করলেই নয়। অটোফ্যাজি শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ অটো ও ফ্যাজি থেকে, যার বাংলা তরজমা দাঁড়ায় স্বভোগ, অর্থাৎ নিজেকে নিজে খেয়ে ফেলা, মানে আত্মবলিদান। শরীরের মরা কিংবা আধামরা কোষগুলো এ পদ্ধতি অনুসরণ করে বিলুপ্ত হয় বিধায় এই প্রক্রিয়াকে অটোফ্যাজি বলে।
বায়োলজির সামান্য জ্ঞান থেকে আমরা জানি যে, কোষের বিভক্তি থেকে নতুন নতুন কোষের জন্ম হয়, পুরোনা কোষগুলো মরে যায়। এছাড়া, নানা কারণে শরীরের সকল কোষ সমানভাবে টিকে থাকতে সক্ষম হয় না, কেউ মারা যায়, কেউ দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন মৃত ও দুর্বল কোষগুলো শরীরের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। খাদ্যের জোগান ঠিক থাকলে সেই কোষগুলো নিভু নিভু ভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে বটে, কিন্তু খাদ্য ঘাটতি দেখা দিলে দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলের মানুষের মতো তারা মৃত্যুমুখে পতিত হয়। ত্বকের মরা কোষ পরিষ্কার করা কঠিন কিছু না, একটু ভালোমতো গোসল করলেই তা হয়ে যায়; কিন্তু শরীরের ভিতরের মরা কোষের বেলায় কাজটি একটু জটিল। বাসাবাড়িতে যেমন ময়লা-আবর্জনা জমে এবং সেগুলোকে প্রতিদিন ঝাড়– দিতে হয়, ঠিক সেভাবে মরা কোষ নামক ময়লা-আবর্জনাগুলোকে সময় মতো ঝেঁটিয়ে বিদায় না করলে একসময় এরা মহাদুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর অবহেলা, অলসতা বা অজ্ঞানতাবশত দীর্ঘদিনধরে তারা শরীরের জমিনে পড়ে থাকলে দিনে দিনে তাদের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এমন হয়ে যায় যে, তাদেরকে আর শরীর থেকে বের করা সম্ভব হয় না।
সমাজে দুষ্টু লোকদের বেলায় যা ঘটে, অর্থাৎ মস্তানরা একত্রিত হয় এবং পুলিশের ওপর খবরদারি করতে শুরু করে, তেমন করে শরীরের বেলায় এই দুষ্টু কোষগুলো পরষ্পরের সাথে হাত মিলিয়ে মস্তান সমিতি গড়ে তোলে। ডাক্তারি ভাষায় যার নাম ক্যান্সার। এই ক্যান্সার কোষগুলো আমাদের ইমিউন বা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখায়। তখন বাইরে থেকে কেমোথেরাপি দিয়ে তাদেরকে শায়েস্তা করা বা সম্ভব হলে শরীর থেকে অপসারণ করার চেষ্টা করা হয়। সফল হলে ভালো, মাস্তানমুক্ত সমাজ আর ক্যান্সারমুক্ত শরীর কে না চায়; কিন্তু অনেক সময় তা হয়ে উঠে না, বিশেষ করে যে সমাজ মস্তানদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় কিংবা মস্তানদের সমাদর করে, সেই সমাজের পক্ষে মস্তানমুক্ত হওয়া প্রায় অসম্ভব এক ঘটনা। একইভাবে, যে শরীর ক্যান্সার নামক মস্তান কোষগুলোকে আদরযত্নে রাখে অথবা ক্যান্সরই শরীরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়, সেই শরীর কীভাবে তা থেকে মুক্ত হবে?
অটোফ্যাজি হচ্ছে শরীরের মরা কোষগুলোকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার প্রক্রিয়া এবং তখনসে যে কেবল মৃত কোষগুলোকে বিদায় করে তা না, বিদায়কালে ওই কোষগুলো থেকে প্রোটিনসহ নানা উপাদান সংগ্রহ করে সেগুলোকে জীবিত কোষগুলোর মাঝে বিলি করে দেয়।
অটোফ্যাজির কাজটি মূলত শুরু হয় অনাহারে থাকার সময়ে, বিশেষ করে সেই অনাহার যদি প্রলম্বিত হয়। কারণ, বাইর থেকে কার্ব তো বটেই, প্রোটিনের সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে এএমপিকে নামক বিপদের বন্ধুর ডাকে কলিজা মশাই শরীরের চর্বিকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে কিটোন বানাতে শুরু করে। আর এই কিটোনই কোষের ভিতরে মাইটকন্ড্রিয়ায় ঢুকে গ্লুকোজের বিকল্প হিসেবে কাজ করে। পার্থক্য একটাই―আগে গ্লুকোজ হজম করতে গিয়ে নিঃশ্বাসের সাথে কার্বন ডাই-অক্সাইড বের হতো, এখন বের হয় কিটোন। এই সময়টিকেই বলা হচ্ছে ফ্যাটমেটাবলিজম। পরে এ নিয়ে বিস্তারিত বলা যাবে, আপাতত অটোফ্যাজি নিয়েই বলি। ফ্যাট মেটাবলিজমের বদৌলতে শরীরে জমে থাকা চর্বি গলিয়ে জ্বালানির অভাব মেটানো গেলেও কোষের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় প্রোটিনের সংকটটা থেকেই যায়, তখন লাইসোসোম নামের জীবিত কোষের উপাদানটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে মৃতপ্রায় কোষের দিকে তার দৃষ্টি প্রসারিত করে। মাইটকন্ড্রিয়ায় শক্তি উৎপাদনের সহায়ক হিসাবে ভিটামিন ডি অথবা পলিফেনলের সরবরাহ ঠিকঠাক থাকলে যতক্ষণ পেটে প্রোটিন বা কার্ব না পড়ছে, ততক্ষণ মরাকোষ থেকে প্রোটিন সংগ্রহের কাজটি চলতেই থাকে। এভাবে একসময় শরীর মরাকোষ মুক্ত হয়। এটি বহুল ব্যবহৃত প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। প্রাকৃতিকভাবে বসবাসরত সকল প্রাণী এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শরীরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করলেও মানুষ এবং গৃহপালিত পশু-পাখির বেলায় তা আর হয় না, মূলত বিরতিহীনভাবে খাদ্য সরবরাহ অটুট রাখার কারণে।
মৃত সকল কোষের বেলায় লাইসোসোম তথা অটোফ্যাজি তার বাহাদুরি দেখাতে সক্ষম হলেও ক্যান্সার-সমিতিভুক্ত কোষগুলোর কাছে সে অসহায়। কারণ ততদিনে চিনি ও চিনিজাত মিষ্টি খেয়ে খেয়ে ক্যান্সারের গতর এতটাই পুষ্ট হয়ে পড়ে যে, সে লাইসোসোমকে তো পাত্তা দেয়ই না, উপর উক্ত শরীরের রক্তনালির সাথে মিতালি গড়ে সেখান থেকে খাবার সংগ্রহ করতে শুরু করে।
শরীরে কান্সারের মতো কোষের জন্ম ঠেকাতে তাই নিয়মিতভাবে অটোফ্যাজিকে কাজে লাগানো দরকার, আর তার জন্য দরকার শরীরকে মাঝেমধ্যেই খাদ্য ঘাটতিতে ফেলে দেওয়া। এক্ষেত্রে, উত্তম উপায় হচ্ছে রোজা রাখা। বিশেষ করে সেই রোজা যদি ১৭-১৮ ঘণ্টার চেয়ে দীর্ঘ হয়, তো অটোফ্যাজি খুব ভালো মতো কাজ করে। ২০১৬ সালের চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল প্রাপ্তির পরে রোজার সাথে অটোফ্যাজির সম্পর্কের বিষয়টি সারাবিশ্বের মানুষের মনোযোগ কাড়তে সক্ষম হয়। আলঝাইমার, ডিমনেশিয়া, কিংবা কান্সার রোগের জন্মের পেছনে শরীরের দুর্বল ও মরা কোষগুলো দায়ী। এসব রোগ যেন শরীরে বাসা বাঁধতে না পারে, সেজন্য দুর্বল ও মরা কোষগুলোকে মাঝে মধ্যে অটোফ্যাজির মাধ্যমে ঝেঁটিয়ে বিদায় করাটা জরুরি।
অটোফ্যাজি কার্যকর করতে রোজা এক উত্তম ব্যবস্থা। এছাড়া, আরও নানাভাবে অটোফ্যাজি সম্ভব। তেমন এক পদ্ধতি হচ্ছে ফ্যাটমেটাবলিজম। মূলত, রোজা থাকাকালীন সময়ে শরীরে জমে থাকা চর্বি গলিয়ে আমাদের শরীর শক্তি উৎপাদন করে। যার আরেক নাম কেটোজেনিক। আহারের সময় কার্বজাতীয় খাবার ১০ শতাংশে নামিয়ে আনলে এবং শক্তির উৎস হিসেবে বেশি বেশি করে চর্বি জাতীয় খাবার খেলে মেটাবলিক কাজে ইনসুলিনের পরিবর্তে গ্লুকাগন তার কাজ শুরু করে এবং এভাবে কয়েক দিন চলার পরে চর্বি খাওয়া কমিয়ে দিলে চর্বিকে ফ্যাটি এসিডে রূপান্তরের একটা বিশেষ পর্যায়ে শরীরের সঞ্চিত চর্বি গলতে শুরু করে। এখন দরকার কেবল খাবারের তালিকা থেকে প্রোটিন বাদ দেওয়া, সেটা মাছ-মুরগি হোক কি ডাল। প্রোটিন তো প্রোটিনই; কিন্তু আমাদের খাবারে তা যদি না থাকে তো শরীরের দুর্বল ও মৃত কোষের প্রোটিনই হয়ে ওঠে অন্যকোষের প্রোটিনের উৎস। এভাবে রোজা না রেখেও অটোফ্যাজির সুবিধা পাওয়া যায়। তবে, রোজাই সর্বোত্তম।
মানবসভ্যতার সূচনা থেকে মানুষ কোনো না কোনোভাবে অনাহার কিংবা অর্ধাহারের মুখোমুখি হয়েছে এবং না চাইতেই অটোফ্যাজির সুবিধাগুলো পেয়ে গেছে। কৃষি সভ্যতায় আসার পরে খাদ্যের অনিশ্চয়তা খানিকটা কেটে গেলে অনাহারের থাকার বিষয়টি বেশিরভাগ ধর্মের অন্যতম স্তম্ভে পরিণত হয় এবং হাজার বছর ধরে সেভাবেই টিকে আছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, নগর সভ্যতায় প্রবেশের পরে, বিশেষ করে চিনি আবিষ্কারের পরে, মানুষ অনেক বেশি করে কার্বনির্ভর হয়ে পড়েছে এবং অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরা তো বটেই, ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা রমজান মাসে একমাসব্যাপী রোজা রাখা সত্ত্বেও অটোফ্যাজির উপকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই বঞ্চনা নির্বুদ্ধিতার এবং অজ্ঞানতার। মুসলমানদের ইফতারি এবং শেহরিতে এত বেশি চিনি ও কার্বজাতীয় খাবার থাকে যে, তাকে শরীরের কোষে কোষে বহন করার কাজে এবং অপ্রয়োজনীয় কার্বকে চর্বিতে রূপান্তরের কাজে ইনসুলিনকে হয়তো ১২-১৪ ঘণ্টাই ব্যস্ত থাকতে হয়। আর ইনসুলিন হরমোনের উপস্থিতিতে গ্লুকাগন নামক প্যানক্রিয়াসের আরেক হরমোন তখন বিশ্রামরত। এমনিতে গ্লুকাগনের মূল কাজ হচ্ছে রক্তে গ্লুকোজ ও ফ্যাটি অ্যাসিডের স্বল্পতা রোধ করা।কিন্তু ইনসুলিন কাজ করতে থাকলে বেকার বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই। এ হচ্ছে ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে এমন কারখানার ২ কর্মীর মাঝে বলবৎ করা এক রোটেটিং সাইকেল। সেজন্য ইনসুলিন বিশ্রামে না যাওয়া পর্যন্ত গ্লুকাগন অপেক্ষা করতেই থাকে এবং তারপর কিটোনের ঘুম ভাঙাতে যখন সে জমানো চর্বির দুয়ারে হাজির হয়, তার আগেই হয়তো ইফতারির আয়োজন শুরু হয়ে যায়। সে কারণে অটোফ্যাজির ভাগ্যে শিকা ছেঁড়ে না। আসলে আমাদের খাবারগুলো কখন কীভাবে শরীরে হজম হয় সে সম্পর্কে একটু খোঁজ-খবর নিলে রোজা এবং অটোফ্যাজি বুঝতে পারা ততটা কঠিন হয় না।
রাতের খাবার দিয়েই চক্রটা শুরু করা যাক। ধরা যাক, সন্ধ্যা ৭ টার মধ্যে রাতের খাবার শেষ এবং সেই খাবারে থাকতে পারে ডাল-ভাত-সবজি, কপাল ভালো হলে মাছ-মাংস, মাঝেমধ্যে বিরিয়ানি আর যদি আরও ভালো কপাল হয় তো ডেজার্ট হিসাবে ফলফলাদি বা দই-মিষ্টি জুটে যেতে পারে। যা-ই হোক, যা কিছু খাই, শুরুতেই সেগুলো থেকে কার্বজাতীয় খাবারকে হজম করে গ্লাইকোজেন আকারেকলিজা মশাই তার ভান্ডারেজমা রাখে। এরপর ৮ ঘণ্টা ধরে কার্বকে গøুকোজে, প্রোটিনকে অ্যামিনো অ্যাসিডে আর চর্বিকে ফ্যাটি অ্যাসিডে রূপান্তরের এবং তাদেরকে কোষের দুয়ারে হাজির করার কাজ চলতে থাকে। কোষ তা নিতে না চাইলে অতিরিক্ত খাবার ট্রাইগ্লিসারিন নামক চর্বি হিসাবে শরীরে জমা হয়। এর মধ্যে আর কিছু না খেলে ৮ ঘণ্টা পরে কলিজা মশাই এর আগে জমিয়ে রাখা সেই গ্লাইকোজেনকে খরচ করতে শুরু করে এবং তা দিয়ে মোটামুটি ৪ ঘণ্টা পর্যন্ত চলতে পারে। সেজন্য রাতের খাবারের ১২ ঘণ্টা পরে, অর্থাৎ সকাল ৭ টার দিকে পেট মোচর দিতে শুরু করে। গেহেরিন নামক হরমোন মগজে সংকেত দিতে থাকে, বলে― খাবার চাই খাবার! তবে, শরীর তাতে থেমে থাকে না। কারণ সে জানে, নানাকারণে খাবার আসতে দেরি হতে পারে। ফলে সে তখন ট্রাইগিসারিন বা চর্বিকে গলিয়ে ফ্যাটি অ্যাসিড ও গ্লাইসরেলকে নিয়ে কোষের দুয়ারে হাজির হয়। কোষের চুলো মাইটকন্ড্রিয়ার তাতে কোনো আপত্তি থাকে না। বলা হয়, সঞ্চিত চর্বি থেকে পাওয়া জ্বালানিই তার প্রথম পছন্দ। এর পরের ৬ ঘণ্টা ভালোই চলে। তবে, শরীরের অন্যান্য কোষ আপত্তি না করলেও মগজ একটু মাইন্ড করে বসে, কারণ ফ্যাটি অ্যসিডের সাইজটা একটু বড় হওয়ার কারণে রক্ত থেকে তা মগজের কোষে ঢুকতে পারে না। কলিজা মশাইয়ের বুকে বসে বসে মাইকন্ড্রিয়া এতক্ষণ এসব লক্ষ করছিল, এবার সে তৎপর হয়, সংকেত যায় মগজের মাইটকন্ড্রিয়ার কাছে, বলে― ঘাবরাও মাত! বলতে বলতে কলিজার মাইটকন্ড্রিয়া কাজ শুরু করে দেয়, ফ্যাটি অ্যাসিডকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে কিটোন নামের খাবারেপরিণত করে তাকে রক্তনালিতে পাঠিয়ে দেয়। আর এই কিটোনের সাইজ এত ছোট যে রক্ত থেকে মগজের কোষে ঢুকতে তার কোনো অসুবিধা হয় না। যাদের শরীরে চর্বি কম কিংবা ফ্যাট মেটাবলিজমে ততটা দক্ষ না, তাদের জন্য এমসিটি অয়েল এক উত্তম বিকল্প, সাথে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড।কারণ মগজ ঠান্ডা তো সব ঠান্ডা। অটোফ্যাজির কাজ অবশ্য আরও আগেই শুরু হয়, তবে খাওয়ার ১৮ ঘণ্টা পরে এর কাজ অনেক গুনে বেড়ে যায়। অর্থাৎ, সন্ধ্যা ৭ টায় ডিনার শেষ করে পরদিন দুপুর ১টা পর্যন্ত পানি, এমসিটি অয়েল, গ্রিন টি, ব্লাক কফির মতো কার্ব বা প্রোটিনবর্জিত খাবার ব্যতিরেকে আর কোনোকিছু না খেলে তখন থেকে শরীরে অটোফ্যাজি শুরু হয়ে যায়।
উপরে যা বললাম, তা শরীরের এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। মূলত, লক্ষ বছর ধরে মানুষ তো বটেই সকল প্রাণীর খাবার ছিল ঋতুনির্ভর, ফলে যে সময় যে খাবার হাতের কাছে পাওয়া যেতো, ভালোমন্দ বাছবিচার করে তাই খেয়ে বেঁচে থাকতো মানুষ। এভাবে গ্রীষ্মকালে প্রচুর ফল খেয়ে খেয়ে মানুষ তার শরীরে চর্বি জমাতো, আর শীতকালে গাছের মূল, অর্থাৎ মিষ্টিআলু, শ্যাকাআলু (কেশর), নানা ধরনের কচু, ইত্যাদি খেয়ে এবং শরীরে জমানো চর্বি গলিয়ে বাঁচতো। কৃষি সভ্যতায় আসার পরে মানুষের খাবারে চাল ডাল সহ নানা ধরনের শস্য যুক্ত হয়। এদের মধ্যে অনেক খাবারকে মানুষ আবার গাঁজন করে সংক্ষরণ করতে শেখে এবং শীতের সময় সেই খাবারগুলো পাতে উঠে আসতো। গাঁজনজাত খাবার, তা সেটা দই হোক কি পান্তা কি আচার, এখনও এসব খাবার মানুষের খাদ্যতালিকায় প্রিয় আইটেম। আর মদ হলে তো কথাই নেই, তখন মানুষের নেশা ঠেকাতে আইন বানাতে হয়, এমনকি ধর্মের আসমানী হাত দিয়েও বিধিনিষেধ নামে। তা সত্তে¡ও খাবার সংগ্রহের বেলায় মানুষের ঋতু নির্ভরতা অটুট ছিল যান্ত্রিক সভ্যতা তুঙ্গে ওঠার পূর্বপর্যন্ত। কিন্তু তারপর থেকে নতুন ধরনের নাগরিক জীবন ব্যবস্থায় এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে মানুষ তার অতীতের সেই ঋতুনির্ভর চক্রের কথা ভুলেই গেছে। অফুরন্ত খাবারের কারণে আমাদের শরীরের কাছে তাই সারাবছরই গ্রীষ্মকাল। তাই হঠাৎ করে উদরে খাবারের জোগান কমিয়ে দিলে শরীর বিভ্রান্তবোধ করে, বিষয়টা তার কাছে অস্বাভাবিক ঠেকে, ভাবে― আকাল নেমেছে আকাল! ফসলের মাঠে ফসল নোই, গাছে ফল নেই, কাজেই যতটুকু খাবার আসছে তা থেকে জমাতে হবে। সেজন্য ওজন কমানোর আশায় হঠাৎকরে খাবারের জোগানে ঘাটতি ফেলে দিলে শরীর দুর্ভিক্ষাবস্থায় চলে যায় এবং যা খাই তা থেকে বেশিরভাগ খাবার সে চর্বি হিসেবে জমাতে শুরু করে। এজন্য রোজা শুরু করার আগে অন্তত কয়েক দিনের প্রস্তুতি নিলে, বিশেষ করে প্যানিক্রিয়াস থেকে গ্লুকাগন হরমোন বের করে তার সহায়তায় ফ্যাট মেটাবলিজমটা শুরু করাতে পারলে শরীর আর স্টারভেশনে যাওয়ার সুযোগ পায় না।

ক্যালগেরি, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent