রবিবার - মে ১৯ - ২০২৪

জীবনধারা কি বদলে যাবে ?

ইন্ডিগো কানাডার একটি নাম করা বইয়ের দোকান এই দোকানের ক্যাফেতে বসে আলাপ করার সুযোগ হয়েছিল একজন বিখ্যাত বিপণনবিদের সাথে আলাপের বিষয় ছিল বাজারে পণ্যের চাহিদা কেন উঠানামা করে তিনি আমাকে নব্বই দশকের একটি মজার ঘটনা বললেন

ইন্ডিগো কানাডার একটি নাম করা বইয়ের দোকান। এই দোকানের ক্যাফেতে বসে আলাপ করার সুযোগ হয়েছিল একজন বিখ্যাত বিপণনবিদের সাথে। আলাপের বিষয় ছিল বাজারে পণ্যের চাহিদা কেন উঠানামা করে। তিনি আমাকে নব্বই দশকের একটি মজার ঘটনা বললেন। নর্থ আমেরিকার একটি নামকরা কসমেটিকস্ কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট লক্ষ্য করলো যে, তাদের টপ সেলিং ব্রান্ড গ্লসি লিপস্টিকের বিক্রয় নাটকীয় ভাবে পড়ে গেল। অন্যদিকে স্কীন কেয়ার প্রোডাক্টের চাহিদা ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করলো। কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তারা ভাবলেন, হয়তো গ্লসি লিপস্টিকের ফেডটা চলে যাচ্ছে এবং নতুন কোনো ফ্যাশন ট্রেন্ড আসছে।
শরু হল এই নিয়ে বিপণন গবেষণা। ক্রেতাদের পছন্দ, ফ্যাশন ট্রেন্ড, বহুসংস্কৃতির প্রভাব, ক্রয় ক্ষমতা ইত্যাদি বহুবিষয়ের সমীক্ষা আর পরিসংখ্যান নিয়ে গবেষণা করলেন বাঘা বাঘা বিপণনবিদগণ। অথচ গ্লসি লিপস্টিকের বিক্রয় পড়ে যাবার এবং স্কিন কেয়ার পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাবার সঠিক কোনো কারণ চিহ্নিত করা গেল না।
অবশেষে একটি তথ্য বের হয়ে এলো যে, চল্লিশ ও পঞ্চাশ দশকের প্রজন্ম যাদেরকে বেবি বুমার বলা হয় তারা নর্থআমেরিকার ক্রেতা সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। এই বেবি বুমার প্রজন্মের বয়স নব্বই দশকে পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই করছে। এই বয়সের স্বচ্ছল মহিলারা গ্লসি লিপস্টিক ছেড়ে ত্বকের যত্নের প্রতি বেশি মনোযোগী। এমনকি পুরুষরাও বয়স ধরে রাখার জন্য ত্বক পরিচর্যার দিকে ঝুঁকছে। এই মিসিং লিংকটা চিহ্নিত করেছিলেন একজন বুদ্ধিমান বিপণন বিশ্লেষক যা অন্যদের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল বা ধারণার বাইরে ছিল। পণ্যের চাহিদা নির্ণিত হয় কোন ক্রেতা গোষ্ঠি মার্কেট ডমিনেট করছে এবং তাদের বয়স যেটি একটি মেজর ফ্যাক্টর।
এছাড়াও আমরা দেখেছি প্রযুক্তির পরিবর্তন কিভাবে বাজার চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করে। ২০০৭ সালে বাজারে এল অ্যাপলের যুগান্তকারী আবিস্কার আইফোন। পাশাপাশি এন্ড্রোয়েড প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্যামস্যাং কোম্পানি বাজারে নিয়ে এল স্মার্টফোন স্যামস্যাং গ্যালাক্সি। আইফোন এবং স্যামস্যাং দ্রæত মোবাইল ফোনের বাজার দখল করে নিল। চাপের মুখে পড়ে গেল নকিয়া, মটোরোলা, সনি ও বøাকবেরি। ল্যাপটপ থেকে ইন্টারনেট সুবিধা চলে এল স্মার্টফোনে। হাতের মুঠোয় খুলে গেল বিশ্বের দরজা। স্মার্টফোন এসে ইন্টারনেট এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে যুক্ত করে প্রভাবিত করল সারাবিশ্বের জনসাধারণকে।
আমরা যদি একটু পেছনের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো কিভাবে প্রযুক্তি প্রভাবিত করেছে পণ্যবাজার এবং বদলে দিয়েছে আমাদের জীবনধারা। এই বিপ্লব বা বদলের পেছনে কি শুধুই প্রযুক্তি না অন্য কিছু? পাঠক, আসুন রিয়ার ভিউ মিররে চোখ রাখি।
ষাট এবং সত্তরের দশকের তরুণ তরুণীদের কাছ গান বা নাটক শোনার জন্য রেডিও ছিল জনপ্রিয় মাধ্যম। পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে গান সংগ্রহ হতো রেকর্ডে এবং শোনার মাধ্যম ছিল গ্রামোফোন। রেকর্ডের পর সত্তরের দশকে এলো ক্যাসেট। আশির দশকে এলো ভিডিও টেপ। নব্বইর দশকে এলো সিডি এবং ডিভিডি। আর এখন সবকিছুই চলে এলো সফট্মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণে অর্থাৎ মোবাইল ফোন, ট্যাবলেট অথবা ল্যাপটপে। নব্বইর দশক পর্যন্ত বিটিভি ছিল একমাত্র টেলিভিশন চ্যানেল। গত দুই দশকে সেই দর্শক মনোযোগ ভাগ হয়েছে শতাধিক টিভি চ্যানেলে। বিশাল হোম থিয়েটারের আগমণের ফলে সিনেমা হল গুলো হারিয়েছে মধ্যবিত্ত দর্শক। গত এক দশক ধরে সিনেমা হলেও চলছে মন্দা। মফস্বল শহরের পুরনো হলগুলো প্রায় চলছেই না। সেই তুলনায় সিনেপ্লেক্সগুলোর বাজার এখনও টিকে আছে। হাতে গোনা কিছু বøকবাস্টার সিনেমা ছাড়া সিনেপ্লেক্সের ব্যবসা মন্দার সম্মুখীন। তাই বলে কি দর্শকরা সিনেমা দেখা কমিয়ে দিয়েছে, তা কিন্তু মনে হয় না। বরং সিনেমা দেখার প্লাটফর্মের পরিবর্তন হয়েছে। তরুণ প্রজন্ম এখন সিনেমা দেখে নেটফ্লিক্স বা অ্যামাজন প্রাইম-এ।
আশির দশক পর্যন্ত ছিল ল্যান্ডলাইন ফোনের যুগ। মনে পড়ে একটি ল্যান্ডফোন লাইনের সংযোগ পাবার জন্য টিএন্ডটি অফিসে ধর্না দিতে হতো। টিএন্ডটির ফোন সংযোগ পাওয়া ছিল একটি কঠিন বিষয়। ক্ষমতাধর সরকারী কর্মকর্তাদের কাছে তদবির, লাইনম্যানকে উৎকোচ প্রদান করার পর ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে তারপর সংযোগ মিলতো। তখন পরিচিতজন অফিসের টেবিলে বা বাসায় না থাকলে তাঁর হদিস পাওয়া ছিল দুঃসাধ্য বিষয়। নব্বইর দশকের মাঝামাঝি সেলফোনের বাণিজ্যিকীকরণ নিয়ে এলো ব্যক্তিগত যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এখন মোবাইল ফোন ছাড়া নিজেকে রীতিমত অসহায় মনে হয়। আর ল্যান্ডফোন সেটে জমেছে ধূলো।
নব্বইর দশকে ইন্টারনেট প্রযুক্তি এসে খুলে দিল বিশ্বের জানালা। কিন্ডেল এনেছে কাগজের বইয়ের ইলেকট্রনিক রূপান্তর। ফলে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অনেক কাগজের বইয়ের দোকান। একদশক আগেও সাবওয়ে ট্রেনে বা বাসে যাত্রীদের হাতে থাকতো বই কিংবা পত্রপত্রিকা। এখন সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে ট্যাবলেট, আইপড, কিন্ডেলসহ যাবতীয় ইলেকট্রনিক গেজেট। সম্প্রতি উবার এসে দখল করে নিয়েছে প্রাইভেট ট্যাক্সির বাজার। আর দখল করে নিচ্ছে প্রথাগত হোটেল ব্যবসার বাজার। আমাজন, ইবে এবং আলিবাবার মত অনলাইন ব্যবসার প্ল্যাটফর্ম এখন ক্রেতাদের মনোযোগ কেড়ে নিচ্ছে এবং বন্ধ হয়ে, যাচ্ছে অনেক রিটেইল শপ।
যাত্রীদের চাহিদার সাথে তাল মেলাতে যেয়ে বিমান বা এয়ারলাইন্সগুলো হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। ভিডিও, মিউজিক, সিনেমার পর এখন যুক্ত হয়েছে ইন্টারনেট এবং উড়ালী দূরালাপনী। প্রযুক্তি দ্রুত বদলে দিচ্ছে আমাদের জীবনধারা। কিন্তু সেই সাথে লুফে নিচ্ছে অনেক পেশা, বাণিজ্য এবং শিল্পসংস্কৃতি। যেমন যাত্রা বা সার্কাস শিল্পীরা এখন বিরল সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছে। বিলিন হয়েছে আশির দশকে পাড়ায় পাড়ায় গড়ে ওঠা ভিডিওর দোকান। ইমেইলের আগমণের ফলে মানুষ এখন চিঠি লেখা প্রায় ভুলেই গেছে। এখন প্রেমপত্র এবং চিরকুটের জায়গা দখল করে নিয়েছে এসএমএস। লং ডিসটেন্স টেলিফোন কলের বদলে তরুণ-তরুণীরা এখন ব্যবহার করে ভাইবার, ইমো, হোয়াটঅ্যাপস বা ম্যাসেঞ্জার। ইউটিউবের আগমণের ফলে সিডি ব্যবসা প্রায় বন্ধের উপক্রম।
চিকিৎসা ক্ষেত্রেও এসেছে যুগান্তকারী পরিবর্তন। এখন সার্জনরা অপারেশনের কাজে রোবট ব্যবহার করছেন। স্টেমসেল গবেষণা হয়তো আমূল বদলে দেবে চিকিৎসা পদ্ধতি। সম্প্রতি মানবদেহে কৃত্রিম কিডনী এবং হৃদপিন্ড সংযোজন ইঙ্গিত দেয় যে আশির দশকের টিভি সিরিজের চরিত্র বায়োনিকম্যানের বাস্তবরূপ আসন্ন।
উনবিংশ শতাব্দীর বিস্ময়কর আবিষ্কার ছিল ফটোগ্রাফী, বিদ্যুৎ, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, ষ্টিমইঞ্জিনের রেলগাড়ি ইত্যাদি। বিংশ শতাব্দীর অবাক করা আবিষ্কার হল রেডিও, টেলিভিশন, অটোমোবাইল, উড়োজাহাজ, সাবমেরিন, রকেট, কম্পিউটার, ইন্টারনেট ইত্যাদি। আর একবিংশ শতাব্দীতে কিছু আবিষ্কার মানুষের জীবনধারা আমূল বদলে দিতে পারে; যেমন- রোবটিকস, জেনেটিক প্রকৌশল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ন্যানো প্রযুক্তি, হাইড্রোজেন জ্বালানি শক্তি ইত্যাদি।
মানুষের সৃষ্টিশীলতা একবিংশ শতাব্দীর প্রজন্মের জীবনধারা কতটা বদলে দেবে তা অনুমান করা গেলেও নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। হয়তো এয়ারপোর্টে রোবটরা ঘোরাঘুরি করবে। যাত্রীদের চোখের মনির দিকে তাকিয়ে বলে দেবে কার কোনো দেশী পাসপোর্ট। কিংবা কার কোনো দেশের ভিসা এবং টিকিট। হয়তো কাগজের টিকিট বা বোর্ডিং পাশ বলে আর কিছু থাকবে না। বিমানের পাইলট এবং কেবিন ক্রুরা হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রোবট। এয়ারপোর্টে নেমেই পাওয়া যাবে চালকবিহীন ট্যাক্সি। কে জানে সেদিনের প্রজন্ম হয়তো ডেকে নিয়ে আসবে সঙ্গীহীনতার মানবীয় কোনো সংকট!

- Advertisement -

Read More

Recent