রবিবার - মে ১৯ - ২০২৪

একাকী একজন

ছবিগ্রেগ রাকোজী আনস্ফলাশ

স্বপ্ন দেখতে দেখতে কেটে গেল জীবনের অর্ধেকের বেশি সময়। প্রায় চলি­শের মতন বয়স হয়েছে। একটা মানুষ কতদিন বাঁচে? একশ তো নয় আর একশ হলেও শেষের সময়গুলো কাটে বিছানায়। ঐ বেঁচে থাকাটা অর্থহীন মনে হয় সাজিদের কাছে। মানুষের জীবনে বোঝা হয়ে থেকে লাভ কি? ওর ইচ্ছা করে যে ক’দিন বেঁচে থাকবে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করবে প্রতিটি সময়। তাই করে আসছে ও প্রায় ওর সারা জীবন। বাবা-মা যা করেছেন ওর সেই হাঁটতে না পারা বয়সে। একটুখানি টলোমলো পায়ে হাঁটতে শিখে উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে ওদের হারিয়ে ফেলল। বছর তিন কি চার বয়সের, গহীন অন্ধকার এক রাতের কথা মনে পড়ে ওর স্মৃতিতে। অনেক কান্না, চিৎকার, শব্দ, আগুন ঝাপসা ঝাপসা স্মৃতিতে হানা দেয়। সে রাতের পর কখনও আর মায়াবতী পানপাতা মুখের নারীকে সে দেখেনি। মাঝে মাঝে রাতের গহীনে হানা দেয় সে মুখ, জাপটে ধরে গলা জড়িয়ে ধরে থাকা সে মধুর স্মৃতি, নাক টেনে পেতে চায় সে পরিচিত ঘ্রাণ। বুনো গন্ধওয়ালা লোমশ বুকের লোকটা ওকে ছুড়ে ছুড়ে দিত উপড়ে আর লুফে নিত সবল হাতে। খিলখিল হাসি ভাঙ্গত ওর ছোট শরীর কেঁপে কেঁপে। মুখগুলো স্পষ্ট মনে পড়ে না। শুধু ঐ স্মৃতি সুখ কষ্ট সব মিলে একটাই আপন স্মৃতি বহু যতেœ ভালোলাগায় বুকে ধরে আছে সারা জীবন সাজিদ। হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর সাথে ওর সব হারিয়ে গেছে। আত্মীয়-স্বজন কেউ আছে কিনা জানতে পারেনি কখনো, জানে না নিজের পরিচয় পর্যন্ত!
কুড়িয়ে পাওয়া ছেলেকে নিজের কাছে রেখেছিল বাদশা মিয়া। গ্রামের হাঁটে চা-পানের দোকান ছিল। খুব চাপা স্বভাবের আর বদরাগী ছিল। কখনই বেশি কথা বলত না, অকারণ ধমক আর চড়-থাপ্পড় দিত। তারপরও লোকটার বুকে মায়া ছিল। নইলে সাজিদকে পালার কি কারণ? একটাই কথা সাজিদ বাদশা মিয়ার কাছ থেকে জেনেছে।
যুদ্ধের সময় কুড়ায়ে পাইছি তোরে। কে তোর বাপ-মা আমি জানি না।
তোমার আর কেউ নাই?
না তোরে পাইলাম আর অন্য সবারে হারাইলাম। নিজের পোলা ভাইবা তোরে বুকে তুইলা লইলাম। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে চুপ করে থাকে বাদশা মিয়া।
বাদশা মিয়াও ছিল এক একাকী মানুষ। চা-পানের দোকানের আয়ে সাজিদ, বাদশা মিয়া আর কুকুর ভোলার দিন গোজরান হয়ে যেত কোনো রকমে। চুপচাপ বসে থাকা তিনটি প্রাণী দিনের পর দিন একসাথে কাটাচ্ছিল। একদিন সকালে বাদশা মিয়া আর জাগল না। দু’দিন প্রচণ্ড কান্নায় চিৎকার করল ভোলা। একসময় থেমে গেল একেবারে। উদাস এক ফাঁকা অনুভূতি নিয়ে নিজের একাকিত্ব অনুভব করতে থাকে সাজিদ।
তখন থেকে একা, একেবারে একা সাজিদ। কালু মিয়া বাদশা মিয়ার ডাকা নামটা ছেঁটে নিজের নাম রাখল সাজিদ মেহরা। কখনই এই কালু নামটা ওর পছন্দ ছিল না। বাদশা মিয়া ওকে রাজা মিয়া ডাকতে পারত, তা না, ধ্যাত কালু মিয়া। কোথায় যে সাজিদ মেহরা নামটা শুনেছে কালু মনে নাই কিন্তু ভালোলাগত। নদীর পাড়ে বসে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে একদিন তাই বদলে দিল নিজের নাম। গ্রামের লোকেরা হাসাহাসি করত, ছোটরা ক্ষ্যাপাত ওকে কালু বলে। কিন্তু নিজেকে আকাশ, বাতাস, গাছ, পাথর নদীর কাছে সাজিদ মেহরা নামে পরিচিত করত আপন মনে একাকী। গান করত নীরবে-নিভৃতে একা একা নদীর পাড়ে বসে। সেই গানের গলা ─ মেলে দিল আকাশে-বাতাসে। একদিন পথের ধারে এক লোক থেমে যায় ওর গান শুনে।

এই ছেলে শোন, আমাকে একটা গান শোনাও তো। গান কখনো কারো জন্য গায়নি। নিজের মতন আপন মনে গেয়েছে। তবু শোনাল লোকটাকে, মন প্রাণ ঢেলে গান করল। কেউ কখনো ওর গান শুনতে চায়নি। বাদশা মিয়া গান শুনলে চড়-থাপ্পড় দিত আর গালিগালাজ। সেই গান আগ্রহভরে শুনতে চাইছে এ লোকটা, এক সপ্তম আশ্চর্য বিষয়। আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। যখন তার গান শুনে সাথে করে নিয়ে আসতে চাইল ঢাকায়। সাজিদ অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল লোকটার দিকে। বারেবারে জিজ্ঞেস করছিল, হাছাই নিবেন আমারে! সত্যিই নিয়ে এল লোকটা ওকে ঢাকায়।
বাদশা মিয়ার মৃত্যুর পর একাকী ছন্নছাড়াভাবে গান গেয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াত তখন সাজিদ। মাঝে-মধ্যে দোকান খুলে বসত কিন্তু এই জীবন ওর ভালো লাগত না। স্কুলে কখনো যায়নি। ওর খুব ইচ্ছা করত আর সব বাচ্চাদের মতন স্কুলে যেতে কিন্তু বাদশা মিয়া খেঁকিয়ে উঠত, ইস ভাত নাই কুত্তার শখ কতো, স্কুলে যামু। দোকানে বসা আর ঘরের কাজ করা, তাও এমন কিছু না। ঘর ঝাড় দেয়া, রান্না করা, পানি তুলে রাখা, কখনও ভাত বা আলু সিদ্ধ দেয়া। এই করতে আর কতক্ষণ, বাকি সময়টা বাদশা মিয়াকে ফাঁকি দিয়ে গান করত আপন মনে, মাঝে মাঝে স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে শুনত বাচ্চাদের সুর করে পড়া। আনমনে সেই পড়া আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে দিত। এই ছিল বাদশা মিয়ার সাথে ওর জীবন।
বাদশা মিয়ার মৃত্যুর পর কোনো শাসনের বালাই নাই। তবু বড় পানসে মনে হয় একাকী এই জীবন। কী যেন করতে ইচ্ছা করে, কোথায় যেতে ইচ্ছা করে, কিছু পাওয়ার আশায় মন উচাটন হয় কিন্তু সে জানে না কোনো পথ। তেমনি সময়ে দেখা হয় আবেদিন আহমেদের সাথে।
বাবা মারা যাওয়ায় নিজের দেশের বাড়ি এসেছেন আবেদিন সাহেব জমিজমার ব্যবস্থা করতে। এছাড়া গ্রামের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। বাবাও তার কাছে ঢাকায় থাকতেন। মা মারা গেছেন বহু বছর। গ্রামের বাড়ি খালি পড়ে আছে অনাদরে। আবেদিন ঢাকায় সেটেল্ড কাজের সূত্রে। এখন তো ঢাকায় অনেক রমরমা অবস্থা। নিজের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা, গাড়িবাড়ি, নামধাম, সামাজিক অবস্থান। এসবের ঘূর্ণিচক্রে দিন চলে যাচ্ছে। এক মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে সংসার, ঝুটঝামেলা কিছু নেই। কাজ আর সামাজিক নানান বিষয়ে সময় কেটে যায়। বাবাও চলে গেলেন। আবেদিন সাহেবের এক বোন বিয়ে হয়ে লন্ডনে থাকে স্বামীর সাথে, সেও অনেক বছর। তিনচার বছর পর পর আসেন দেশে স্বামী-সন্তানসহ। ঢাকায় আবেদিন আহমেদের বাসায় থাকা হয়। হৈ হৈ করে ফূর্তিতে কক্সবাজার, ইন্ডিয়া যাওয়া হয় সে সময়ে পরিবারের সবাই মিলে। এছাড়া ঢাকার বড় বড় দেশি-বিদেশি রেস্টুরেন্টে পার্টি চলে একমাত্র ছোট বোনের উপলক্ষে। গ্রামের বাড়িতে আসা হয়ে উঠে না কখনই। শহুরে জীবনের অভ্যস্ততায় কী এক অজানা আশঙ্কায় ভীতু হয়ে উঠেন সবাই গ্রামের নামে। ঢাকার অদূরে গ্রামে নিজেদের ভিটাবাড়িতে প্রায় ছয়-সাত বছর পর এসেছেন আবেদিন সাহেব। একজন লোক আছে যে বাড়ি-জমি তদারকি করে। মাঝে মাঝে ফল, সবজি নিয়ে হাজির হয় ঢাকায় বছরে দু’একবার। খবরাখবর দেয় নিজের তাগিদে। বাবাই হয়তো যোগাযোগ রাখতেন শুকুর আলীর সাথে। আবেদিন আহমেদ কোনো আগ্রহ অনুভব করতেন না এইসব বিষয়-সম্পত্তিতে। সব বিক্রি করে গ্রামের পাট চুকিয়ে দিতেই তিনি এসেছেন। জমি, বাড়ি বিক্রি করতে এসে কথাবার্তা বলে দু-তিন দিনে চলে যাওয়ার কথা। দূর সম্পর্কের এক চাচার বাড়িতে উঠেছেন। কিন্তু কেমন যেন এক আলসেমি অবকাশ পেয়ে বসেছে। ঘুরে ঘুরে দেখছেন বাড়ির চারপাশ। শুকুর আলী আর ওর বউ মিলে বেশ গাছগাছালি লাগিয়েছে। পেয়ারা, ডালিম, সুপারী, নারিকেল, কলা। বাড়ির পিছনে সবজি বাগান। পুকুরে অল্পকিছু মাছের চাষ। হাঁস-মুরগি ঘুরে বেড়াচ্ছে কয়েকটা। আবেদিন আহমেদের উপলক্ষে ডিম, পুকুরের মাছ, ঘরের মোরগ, ফল, সবজি এনে দিচ্ছে চাচার বাড়ি প্রতিদিন শুকুর আলী। গ্রামের খোলা হাওয়ায় ঘুরে বেড়াতে বেশ ভালো লাগছে আবেদিন আহমেদের।
প্রায় হাঁটতে হাঁটতে সরিষা ক্ষেতের পাশে ধানের ক্ষেতের পাশে চলে যাচ্ছেন, বসে থাকছেন উদাসী হয়ে খোলা হাওয়ায়। ছোটবেলার নানান স্মৃতিতে হচ্ছেন আনমনা। মন পরিবর্তন করে ভাবছেন বাড়ি বিক্রি নয়, সারাতে হবে। মাঝে মাঝে এসে নিরালায় কাটান যাবে। ঢাকা শহরে বড় অস্থিরতা।
এমনি একদিন নদীর ধারে বসে থাকার মাঝে শুনতে পেলেন সুমিষ্ট কণ্ঠের গান। আপন মনে গান গেয়ে গেয়ে চলে যাচ্ছে একটি কিশোর। উদাত্ত কণ্ঠ নির্মল ভালোলাগায় মিশে যাচ্ছে চারপাশে। পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার সময় ডাকলেন গায়ককে। গান শুনলেন আর খুব ভালো লাগল আবেদিন আহমেদের ছেলেটার গান। কাজের বাইরে অবকাশ জীবনে থেকেও কাজ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। এমন একটি সপ্রতিভ গলা সাধনা আর সুযোগ পেলে অনেক উপরে উঠে যেতে পারবে। ছেলেটাকে ঢাকায় নিয়ে যেতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু অভিভাবক রাজি হবে কিনা বুঝতে পারবে কিনা এই প্রতিভার মূল্য তা ভেবে অস্থির হলেন।
─ খোকা তুমি খুব ভালো গান করো তুমি সেটা জান কি?
─ মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায় ছেলেটি।
─ কেমনে জানো, কেউ বলেছে?
─ নাহ, আমি নিজেই জানি।
─ তাই নাকি, ইন্টারেস্টিং তো; ছেলেটার সাথে কথা বলতে আগ্রহী হন আবেদিন সাহেব।
─ তোমার নাম জানা হলো না?
─ সাজিদ মেহরা।
─ বাহ! সুন্দর নাম, কে রেখেছে তোমার এই নাম?
─ আমি
─ তুমি! একটু ধাক্কা খেলেন আবেদিন আহমেদ। ছেলেটা কিছুতেই আর দশজনের মতো নয়। তোমার মা-বাবা কারা?
─ আমার কেউ নেই।
─ তোমার গার্জিয়ান তাহলে তুমিই?
─ জী স্যার।
─ তোমার কেউ নেই কেন বলবে আমাকে?
─ আমি হইলাম কুড়াইয়া পাওয়া মানুষ। এই গ্রামে একজন মানুষ আছিল নাম বাদশা মিয়া। যুদ্ধের সময় হেয় আমারে কুড়াইয়া পাইছে। পাকি আর্মির ডরে ম্যালা মানুষ লুকাইয়াছিল এক জায়গায়। হেইখান থাইকা ভাগনের সময় নিজের পোলা মনে কইরা আমারে কোলে লইয়া দৌড়াইছিল। একদিন বাদে যখন আমার মুখের দিকে ভালা কইরা চাইছে তখন দেখে আমি হের পোলা না। বউ আর পোলারে খুঁইজা পায় নাই। আমার বাপ-মারও খবর পায় নাই। আমারে লইয়াই জীবন কাটাই দিল।
অনেকক্ষণ কথা বলে থামে সাজিদ। লম্বা করে শ্বাস নেয়। নিজের কথা কখনও কাউরে বলে নাই। এই লোকটা কেন জানতে চাইতেছে? ও মন খুলে বলে যাচ্ছে। মজা লাগছে ওর।
─ বাদশা মিয়া এখন কোথায়?
─ এক বছরের মতন হইল মারা গেছে।
আবেদিন আহমেদ দুঃখ পেলেন নিঃসঙ্গ একাকী একজন মানুষের কথা শুনে। একসময় ছেলেটাকে বলেই ফেললেন নিজের মনের কথা।
─ আমার সাথে যাবে?
─ কই যামু?
─ ঢাকা।
─ কি করমু?
─ গান করবে।
হাজার প্রজাপতি যেন একসাথে পাখনা মেলে উড়ছে সাজিদের চারপাশে। আবেদিন আহমেদের কথা শুনে এক অজানা স্বপ্নের অস্থিরতা জেগে উঠল ওর মনে। যে স্বপ্ন ওর মনে ঘুমিয়ে ছিল। আগ্নেয়গিরির লাভার মতো যেন তা ছুটে বেরুল প্রজাপতির পাখায়।
─ আমারে গান করতে নিবেন আপনার লগে? অবাক করা প্রশ্ন সাজিদের।
─ হ্যাঁরে বাবা, আমি তোমাকে গান করতে নিয়ে যাব। তবে তোমাকে লেখাপড়াও শিখতে হবে। তোমার মধ্যে প্রতিভা আছে আমি তার যতœ করব। তোমার নিজেরও তাকে পরিচর্যা করতে হবে।
সব কথা ভালো করে বুঝল না সাজিদ। শুধু মনে হলো এই লোকটা ফেরেস্তার মতন।
─ হ আমি যামু।
─ ঠিক আছে তাইলে তৈরি হয়ে যাও। দু-একদিনের মধ্যে আমরা ঢাকা যাব।
─ আচ্ছা।
─ তুমি থাকো কই?
─ বাদশা মিয়ার যে ঘরটা আছে ঐ যে ক্ষেতের শেষ সীমানায় ঐখানেই থাকি আর বাজারে মাঝে-মধ্যে চা-পান বেচি।
─ চল তোমার আস্তানাটা দেখে আসি।
একখানা মাটির ঘর। চালের খড় ঝরঝরে পাতলা হয়ে গেছে। আধো অন্ধকার ঘরের ভিতর একখান তোক্তপোষ। একপাশে টানানো দড়িতে ক’খানা কাপড়। তাকের উপর একটা টিনের ট্রাংক। একটুখানি উঠানের একপাশে ভাঙ্গা বেড়ায়-ঘেরা দেয়া রান্নার জায়গা, দুচারটা থালা-বাটি, মাটির পাতিল। কত কম সরঞ্জামে মানুষ জীবনযাপন করতে পারে।
আবেদিন আহমেদের চোখের কোণ চিকচিক করে উঠে। এর আগে কখনও মানুষের এমন হতদরিদ্র অবস্থার কাছাকাছি যাননি তিনি। ছেলেটার জন্য বড় মায়া হয়।

- Advertisement -

দু’চারজন স্থানীয় মানুষের সাথে কথা বলে জানতে পারেন, বাদশা মিয়া যুদ্ধের আগে এস্রাজ বাজিয়ে গান করত হাটে। যুদ্ধে সব হারিয়ে গানও হারিয়ে ফেলে। তাই কালু গান করলে ওর রাগ হতো বেশি। রুক্ষ মেজাজের এক অন্য মানুষ হয়ে গিয়েছিল গান-পাগলা বাদশা মিয়া। তবে কালুকে খুব আদর করতো।

আবেদিন আহমেদের কালুকে ঢাকা নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাবটা সবাই প্রশংসা করলেন। কুড়াইনা ছেলে তেমন আদর যতœ পায়নি কখনো। তবু বাদশা মিয়া দেখভাল করে রাখতো। এখন তো পুরা ভাদাইমা গান গায় আর ঘুরে বেড়ায়। তবে গানের গলা ভালো ছেলেটার। আবেদিন আহমেদ নিয়ে গেলে ভালোই হবে।

বেড়ে উঠার সেই গ্রাম ছেড়ে আরেক কুড়িয়ে পাওয়া মানুষের সাথে সাজিদের সেই চলে আসা। প্রথম কিছুদিন ঢাকার জীবনে নিজেকে মানাতে, নতুন অনেক কিছু শিখতে বেশ কষ্ট হয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে এক দৌড়ে চলে যেতে খোলা মাঠের কাছে, নদীর কাছে। তবে গান শিখার বিষয়টা, গান গাওয়ার সুযোগ সব কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছে, ঢাকায় টেনে রেখেছে সাজিদকে। বাসায় আসা শিক্ষকের কাছে মনপ্রাণ ঢেলে লেখাপড়া করছে। আবেদিন আহমেদ প্রতিদিন খোঁজ-খবর করতেন কেমন চলছে শিক্ষা। বারো-তেরো বছরের একটা ছেলের পক্ষে প্রাথমিক অবস্থা থেকে শিক্ষা লাভ করা খুব সহজ না। তবে আগ্রহের জন্য এগিয়ে গেছে তরতর করে সাজিদ। বছর পাঁচ ছয় পরে প্রথম গান করে সাজিদ টেলিভিশনে। সদ্য তরুণের আবেগভরা গানে সুরের জাদুতে মাতাল মানুষ।

টেলিভিশনের পর্দায় দেখলো সাজিদ মেহরার চেহারা দেশের মানুষ। সেই সাথে বিভোর হলো ওর গানে। বদলে গেল ওর জীবন। অনেক অজানা কিছুর সাথে পরিচয় হলো। পরিচয় হলো নানান মানুষের সাথে। অন্য রকম জীবনের সাথে। কোনো রকমে খেয়ে পরে বাঁচা সাজিদের জীবন বদলে যায় এক নতুন পথ নির্দেশনায়। একাকী মানুষ নিজের মধ্যে ম্রিয়মাণ হয়ে থাকা সাজিদ মেহরা মানুষের প্রাণে স্থান করে নিল। মানুষের ভালোবাসা ওর গানের জন্য, ওর জন্য। দেশ-বিদেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গেয়ে বেড়াচ্ছে। কত মর্যাদা, কত সম্মান। অবাক হয়ে ভাবে পথে কুড়ানো মানুষকে মানুষ ভালোবাসে এভাবে? বাদশা মিয়ার পর আবার ওকে পথ থেকে কুড়িয়ে নিয়ে এলো আবেদিন আহমেদ। বাদশা মিয়ার কাছে জীবন পেয়েছিল। নয়তো সেই যুদ্ধের সময় অসহায় এক শিশু হারিয়ে যেত আবর্জনার মতো। মৃত ভেবে ঠুকরে খেতো হয়তো শিয়ালে-শকুনে। অথবা মরেই যেত গুলি-বোমার খপ্পরে।
বাদশা মিয়ার পান-বিড়ির দোকান ঠেলে কোনোমতো দিন কেটে যেত হয়তোবা। অথচ কার ইশারায় খুঁজে নিয়ে এলো আবেদিন আহমেদ।
সুখ-সাগরের অলস নিরালা সময় এই ভাবনায় তলিয়ে যেতে বড় ভালোলাগে সাজিদের। আবেদিন আহমেদের কল্যাণে শিক্ষা, পরিচিতি, নাম, সম্মান, টাকা-পয়সা সব অর্জন করল। আবেদিন আহমেদ লোকটা ভালো। নিজ তদারকিতে অনেক কিছু শিক্ষা দিয়েছেন সাজিদকে। গুরুর কাছে গানের তালিম নিয়ে মার্জিত শিক্ষা, দীক্ষায় বাউণ্ডেলে ভবঘুরে স্বভাবের সাজিদ এক নতুন পথনির্দেশনা পায়। এসবই আবেদিন আহমেদের ইচ্ছায় হয়েছে। তবে সাজিদও তার সমস্ত কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। আবেদিন আহমেদকে ওর বাবা ডাকতে ইচ্ছা করে। বাবা যেমন সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়ে দেয়, তার ভূমিকাও তেমন ওর জীবনে। কিশোর বয়সের এক ছেলেকে অজ্ঞাত অবস্থা থেকে তুলে এনে সম্ভাবনার চরম শিখরে পৌঁছে দিয়েছেন। সাজিদ বুকের ভিতর এই বাবাকে ধরে রাখে কিন্তু প্রকাশ্যে কখনো কিছুই সম্বোধন করে না।
আরো গভীর গোপনে রাখে লিমার কথা। লিমা আবেদিন সাহেবের মেয়ে। একসাথে চলতে চলতে সাজিদের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে লিমা। সাজিদ মেনে নিতে পারে না লিমার ভালোবাসা। ওর বড় ভয় হয়। ওর মনে হয়, ও তো লিমার যোগ্য নয়। লিমা ওর বোনের মতন। অনেক ভালো বড় ঘরে বিয়ে হবে লিমার। সাজিদের নামধাম হয়েছে কিন্তু সে তো নিজের বংশ পরিচয়ও জানে না। অকৃতজ্ঞ হতে পারবে না সে আবেদিন সাহেবের প্রতি, পারবে না তাকে কষ্ট দিতে।
এক যুগের বেশি সময় আবেদিন আহমেদের বাসায় সাজিদ। প্রথম দিকের সময়গুলো কেটেছে ভয়, আগ্রহ, কৌতূহল আর শিক্ষার একনিষ্ঠতায়। শেষের দিকের সময়গুলো অনেক বেশি ব্যস্ততার। গান রেকর্ডিং, টেলিভিশন প্রোগ্রাম, লাইফ পারফরমেন্স দেশে-বিদেশে। প্রতিদিন অনেক মানুষের সাথে পরিচয়। অনেক আবেগ আর ভালোবাসা। নতুন অনুভূতি জীবনের এই সময়টা অনেক মূল্যবান। কোথাও যেন ভুল না হয় আবেদিন আহমেদের সে নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে চায় সাজিদ। ঠিক সে সময়ে অসম্ভব এক পরিবর্তন নিয়ে হাজির হয় লিমা, প্রতিক্ষণ ওর চেষ্টা সাজিদকে ভুল পথে টেনে নিয়ে যাওয়ার। লিমাও অসম্ভব ভালো গান করে, প্রচুর সম্ভাবনা। অথচ সে প্রতিশ্র“তির চেয়ে আবেগের হালকা মেজাজে ভেসে যেতে ভালোবাসে বেশি। সাজিদ বোঝানোর চেষ্টা করেছে অনেক। দু’একবার মাথা এত গরম করে ফেলেছে লিমা উল্টাপাল্টা কথা বলে, সাজিদ চড়-থাপ্পড়ও লাগিয়ে দিয়েছে। এসব কিছুই কোনো প্রতিক্রিয়া করছে না। লিমা যেন ঘোরের মাঝে আছে।

একরাতে অসম্ভব ক্লান্ত সাজিদ ঘুমের ঘোরে আবিষ্কার করে লিমা ওর পাশে শুয়ে আছে ওকে জড়িয়ে ধরে। শীতের সেই ভোররাতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে সাজিদ। ভোর থেকে সকাল, দুপুর, বিকাল হাঁটতেই থাকে সাজিদ এক অস্বস্তিকর আর অসুস্থ চিন্তার তাড়নায়। যদি কেউ দেখে লিমাকে ওর ঘরে শুয়ে থাকতে, কি ভাববেন আবেদিন আহমেদ? কীভাবে নিবেন লিমার মা বিষয়টা। ভয়ে দুর্ভাবনায় হাত-পা কাঁপতে থাকে সাজিদের। লিমা কি চায়? কেন ও এভাবে সাজিদকে বিপদে ফেলে দিচ্ছে? ও তো বুঝিয়ে বলেছে কতবার, লিমাকে বোনের মর্যাদা দেয় সে আর অন্য কিছু ভাবতে পারে না ওকে।
ভালোবাসা প্রেম এসব কি সাজিদের জীবনের কিছু ? সাজিদ সযতেœ নিজেকে দূরে রাখে সবকিছু থেকে। কিন্তু দিন দিন লিমার ব্যবহার হয়ে উঠছে উগ্র থেকে উগ্রতর। বাসায় কথা বলতে গেলে উচ্চস্বরে কথা বলতে থাকে মা-বাবাকে শুনিয়ে, যেন সাজিদকে হেয় করার ইচ্ছা। কোনো কথায় কী বলে, বসে সাজিদ ভয়ে ভয়ে থাকে সারাক্ষণ। বান্ধবীর বাসায় বা শপিংয়ে যেতে ড্রাইভার নেবে না, সাজিদকে নিয়ে যেতে হবে। পথে বেরিয়ে বলবে চলো লংড্রাইভে। লিমা কিছুই তোয়াক্কা করে না যেন। সাজিদ মরমে মরে যেতে থাকে। সাজিদের মনে হয় ভালোবাসার কথা বলছে লিমা কিন্তু ও ভালোবাসা কি তা জানে না, সাজিদের সাথে শারীরিক সম্পর্ক চায়। লিমার মতিগতি দিন দিন অধঃপতনের দিকে যাচ্ছে। সাজিদ বুঝে পায় না বাসায় ফিরবে কীভাবে। লজ্জায় মরমে ও মরে যাচ্ছে।
সারাদিন পথে হেঁটে হেঁটে সাজিদ বিকালে আবেদিন আহমেদের অফিসে পৌঁছে। আবেদিন সাহেব বাইরে একটা মিটিং সেরে তখনই ফিরেছেন। আজ একটু তাড়াতাড়ি বাসায় যাবেন ভেবেছেন। সব গুছিয়ে উঠছেন, এমন সময় সাজিদ এসে ঢুকল।
ওর দিকে তাকিয়ে ভয়ানক চমকে উঠলেন আবেদিন আহমেদ।
─ কী ব্যাপার, তোমার একি অবস্থা? শরীর খারাপ? বসো বসো একসাথে সব কথা বলে ফেলেন আবেদিন আহমেদ।
─ একটু পানি খাবো।
আবেদিন আহমেদ নিজেই পানি নিয়ে আসেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, এমন অস্থির লাগছে কেন? শরীর বেশি খারাপ?
এক নিঃশ্বাসে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করে একটু স্থির হয়ে আবেদিন আহমেদের চোখের দিকে সরাসরি তাকায় সাজিদ।
─ আমি কিছু কথা বলতে চাই।
─ বলো।
─ কোনোদিন বাবাকে দেখিনি। বাবার স্নেহ-ভালোবাসা জানিনি। আপনার কাছে সে অপূর্ণতা পূর্ণ হয়েছে। আপনি আমার জীবন গড়ে দিয়েছেন। নিজের বাবাও হয়তো এমন করে আমাকে বুঝতো না যেমন আপনি বুঝেছেন। বাইরের জগতে আপনার ছেলের পরিচয়ে পরিচিত করেছেন। আপনার ঋণ কখনও শোধ করতে পারব না।
─ এসব কথা কেন আসছে? তোমার কি কোনো কারণে বেশি মন খারাপ?
সাজিদ খানিক চুপ করে থেকে হঠাৎ করেই বলে ফেলে,
─ আমি অন্য কোথাও একা থাকতে চাই।
আবেদিন আহমেদ থমকে যান ওর কথা শুনে। বুকের মাঝে কষ্ট হয়, অভিমান খেলা করে। কিছুই বলতে পারেন না। জানালার পাশে গিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকেন, খানিক পায়চারী করেন ঘরের মধ্যে। মনের ভিতর ভেসে যায় অনেক কথা, অনেক স্মৃতি একসাথে। সব কিছুর পর সাজিদের এই মুহূর্তের মুখটা চোখে ভাসে আর মনে হয় ছেলেটা কিছু একটা গোপন করতে চাচ্ছে, যা তাকে অনেক কষ্ট দিচ্ছে।
এই ভাবনা আসার পর তিনি অনেক শান্ত হন। ধীরে ধীরে ফিরে আসেন সাজিদের পাশে। চেয়ার টেনে বসেন মুখোমুখি। সরাসরি সাজিদের মুখে তাকিয়ে বলেন,
─ সত্যি বিষয়টা নির্দ্বিধায় জানাতে পারো।
সাজিদ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আবেদিন আহমেদের মুখে। ধীরে ধীরে খুলে বলে লিমার ব্যবহার।

জন্ম মানুষের ইচ্ছায় হয় না। মানুষ হয়ে জন্ম নিয়েও অনেকে মানুষ হয় না। যারা মনুষ্যত্ব দিয়ে নিজেদের পশুত্ব থেকে আলাদা করতে পারে তারাই সত্যিকারের মানুষ। বংশ-পরিচয় ইত্যাদি মানুষের সৃষ্টি। অর্থ বিত্ত শিক্ষা দিয়ে মানুষ যাচাই করা যায় না। যদি না মানুষ স্বশিক্ষা লাভ করে।
তুমি একজন মানুষ হিসাবে আমার কাছে অনেক উপরে। তোমার বংশ পরিচয় আমার প্রয়োজন নাই। তবে লিমাকে তুমি বোনের মতন দেখো এটাই ঠিক। পাশাপাশি ভাইবোনের মতন তোমরা বড় হয়েছো। লিমা যদি তোমার সাথে এমন আচরণ করে সেটা ঠিক না। তুমি আলাদা থাকলে যদি তোমার স্বস্তি লাগে তবে তুমি তাই থাকো। কালই আমি তোমার জন্য বাসা ঠিক করে দিব।
আবেদিন আহমেদের কথা শুনে এতই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে, উঠে তাকে সালাম করতে যায় সাজিদ।
আবেদিন আহমেদ ওকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। চলো একসাথে বাসায় ফেরা যাক। তোমার মা কয়েকবার ফোন করেছে, সকাল থেকে তোমার কোনো খবর নাই। না খেয়ে না বলে কোথায় গেছো? বড় উতলা হয়ে আছে সে।
চলেন যাই তবে বাসা আমি খুঁজে বের করব আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।
আচ্ছা, দেখো আবেদিন আহমেদের ছেলের থাকার উপযুক্ত বাসা যেন হয়। হেসে ফেলে সাজিদ। বুকের ভার হালকা করে দু’জনে বাড়িতে রওনা হন।

টরন্টো, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent