রবিবার - মে ১৯ - ২০২৪

অজানা দেশ

ছবিএয়ার কানাডা

প্লেনে পাশাপাশি সিটে বসে আছে দু’জন, কারো মুখে কোনো কথা নাই। তাতাই বাংলাদেশ যাচ্ছে একা। ওর মার অনেক নিষেধ ওকে মানাতে পারেনি। মা, আমি তোমার মতন ভয় খাওয়া মেয়ে না। বাংলাদেশে বড় হয়ে তুমি এখন লন্ডন ভেজে খাচ্ছো আর আমি লন্ডনে বড় হয়ে একা বাংলাদেশে যেতে পারব না এমন ধারণা কেন তোমার?

তোমরা এ যুগের মেয়েরা কিছু বুঝতে চাও না। সব তোমাদের ধারণা মতন চলে না। তুমি লন্ডনে বড় হয়েছো। তোমার জন্ম হয়েছে লন্ডনে। এদেশে চলাফেরা অনেক নিরাপদ। বাংলাদেশে তুমি এমন সব উদ্ভট পরিস্থিতির শিকার হবে, যা কল্পনাও করতে পারবে না।
কেমন উদ্ভট পরিস্থিতি মা বর্ণনা করো।
ধরো তুমি মার্কেটে গেছো কেনাকাটা করতে, কেউ যদি তোমাকে কিছু বলে তুমি কি করবে?
কী বলবে মা! যা বলবে তার উত্তর দিব, এতে খারাপের কি হলো। মানুষ তো কথা বলতেই পারে।
মেয়েকে পরিস্থিতি বোঝাতে পারেন না সুরাইয়া, উল্টা নিজেই লজ্জা পেতে থাকেন। কিন্তু বুঝিয়ে বলা দরকার অথচ ওদের মতন অকপটে সব কথা মুখ দিয়ে বলে দিতে পারেন না তিনি।
কি হলো মা, কিছু বলো না তো?
তুমি যেমন সহজ কথা ভাবছো তেমন না। ধরো তোমাকে খারাপ কথা বলল, গালি দিল।
তা করবে কেন? অবাক তাতাই!
আরে বাবা কেমনে বোঝাব তোমাকে।
ওহ বুঝেছি, খারাপ কথা আই মিন ডার্টি ওয়ার্ড।
ও এখানেও বলে এমন বাজে কথা লোকেরা। আমি পাত্তা দিব না, বেশি বিরক্ত করলে পুলিশ ডাকব।
আহারে মা, পুলিশ তোমার লন্ডনের মতন রেডি হয়ে বসে আছে ভাবছো?
কেন পুলিশ রেডি থাকবে না, কেন? ওদের কাজই তো মানুষের বিপদে সাহায্য করা।
ওটা বাংলাদেশ, ওখানে পুলিশ সাথে সাথে আসবে না।
বিষয়টা তাতাই’র মাথায় কাজ করে না। পুলিশ আছে কিন্তু মানুষের বিপদের সময় উপস্থিত হবে না ওরা তাহলে কেমন পুলিশ?
সুরাইয়া বলেন, তোমার ওড়না ধরে টান দিল ।
আহ মা সিলি আমি ওড়না পরব না।
মরিয়া হয়ে সুরাইয়া বলেন,
তোমার গায়ে হাত দিয়ে দিল কেউ, তুমি চেন না জান না কেমন লাগবে?
দেটস টু মাচ, এটা করবে কেন?
কেনোর উত্তর নাই, এমন টু মাচই করে। তাই বলছি একা যাওয়ার দরকার নাই।
মা, তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে বাংলাদেশে মানুষ বাস করে না।
করে রে মা, বড় কষ্টে বাস করে। সব সময় খারাপ হয় তা না, কিন্তু হওয়ার সম্ভাবনা বেশি তাই ভয় লাগছে।
তোমার সাথে যখন গেছি তখন তো কিছু হয় নাই।
তখন ছোট ছিলে আর আমরা সব সময় সাবধানে চলাফেরা করেছি।
আমিও সাবধানে চলাফেরা করব, ডোন্ট ওয়ারি। তাছাড়া মামা-মামী, লিমাপা, সাজিদ ভাই ওরা সবাই আছে না? দে উইল বি উইথ মি।
মায়ের অনেক আশংকার মাঝে তাতাইর জেদ প্রাধান্য পায়। তাতাই মনে করে মা ওকে এখনও সেই ছোট মেয়েটিই ভাবে। ও যে কত বড় হয়ে গেছে তা মা মানতে চায় না। সব সময় আঁচলে বেঁধে রাখতে চায়। তাতাই জানে পৃথিবীটা অনেক সুন্দর আর সুন্দর মানুষ। কিছু মানুষ হয়তো খারাপ পৃথিবীতে। তার মানে এই নয় যে ওদের জন্য পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে, ওদের জন্য সব ছেড়ে ঘরে বসে থাকতে হবে বাকিদের। তাতাই ঘুরে বেড়াতে চায়, কাজ করতে চায় মানুষদের জন্য।
বাংলাদেশে সে কয়েকবার গিয়েছে। অনেক মজা হয় ওখানে, সবাই এত আন্তরিক। এত খাওয়া-দাওয়া। সারাদিন সব রান্না করছে আর খেতে বলছে। যদিও তাতাই অত খেতে পারে না আর সে সময় ভালোও লাগত না ঐসব খেতে ওর। কিন্তু পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর থেকেই সে ভেবে রেখেছে এবার দেশে যাবে। সবার দেয়া সব খাবার খাবে। সবাইকে খুশি করবে।
নানুকে খুব মিস করছে তাতাই। নানু কি আদর করত। কোলে নিয়ে বসে থাকত আর মুখে তুলে খাওয়াতো। যদিও তাতাই তখন অনেক বড়, আট বছর বয়স কিন্তু নানুর কাছে ও যেন ছোট্ট বেবি। নানুকে আর পাওয়া যাবে না। তবে নানুর একটা কথা খুব মনে পড়ছে আজকাল তাতাইর। ওকে আদর করতো আর নানু বলত, ‘শোন বোন তুমি অনেক বিদ্বান হবে বহুত বড় হবে তখন কিন্তু এই বাংলাদেশকে ভুলে যেও না। এদেশের অভাগা মেয়েদের জন্য কাজ করো, ওদের সাহায্য করো। আমি জানি তুমি পারবে।’

- Advertisement -

তাতাই মাকে তার গভীর গোপন অভিলাষের কথা বলেনি। তাহলে মা যেতেই দিবে না। বিয়ে দেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে যাবে। মার কাছে মেয়েদের জীবন হলো বিয়ে করার জন্য। তাতাইর কাছে বিয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। হয়তো করবে, হয়তো না। দুটো সম্পর্ক হয়েছিল ওর স্কুলে থাকতে। গ্রেড নাইনে থাকতে যে সম্পর্কটা হলো সে ছেলেটা ওকে সারাক্ষণ নিজের করে রাখতে চায়। তাতাইর আর কোনো বন্ধু থাকবে না। কারো সাথে মিশতে পারবে না। কথা বলতে পাবে না, মুভিতে যেতে পারবে না। শুধু ওর সাথে ঘুরাফেরা কথা বলা। কয়েক দিনেই হাঁপিয়ে উঠেছিল তাতাই। জীবনটা হয়ে গিয়েছিল বড় পানসে। ছেলেটাকে ওর আর ভালোলাগে না। পনের-বিশ দিনের মাথায় সম্পর্ক শেষ।

এরপরের সম্পর্কটায় গ্রেড এলেভেনে পড়ার সময়। ছেলেটা ওর সাথে শারীরিক সম্পর্ক করতে চাইত। তাতাই তখন জানে এই সম্পর্কের ফলে ও প্রেগনেন্ট হয়ে যেতে পারে। সে স্কুলে পড়ার বয়সে বাচ্চা চায় না। সে সময় শুনে ওর অন্য বন্ধুর সাথে ওর প্রেমিকের সম্পর্ক। তাই কিছুদিনের মধ্যে এ সম্পর্কটাও শেষ হয়ে যায়। এরপর তাতাই নিজের কেরিয়ার নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়। জীবন অনেক খোলামেলা। কত কিছু শিখার আছে, জানার আছে। এই নিজের মতন একটা জীবন তাতাই’র বেশি ভালোলাগে। তাতাই নানুর অভিলাষ পূরণ করার একটা ইচ্ছা নিয়ে বাংলাদেশে যাচ্ছে।
ও এবার গ্র্যাজুয়েশন করেছে অক্সফোর্ড থেকে সোশ্যাল সাইন্স সাবজেক্টে। তেইশ বছরের এক ঝকঝকে স্মার্ট মেয়ে। ভীষণ চঞ্চল প্রাণভরপুর। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় পুরো পাঁচ বছর বাংলাদেশে যায়নি।
মাঝে একবছর সাউথ আমেরিকায় ছিল এক্সচেঞ্জ স্টুডেন্ট হিসাবে।
অন্য পরিবারের সাথে থাকা বেশ অন্যরকম একটা অভিজ্ঞতা। সে সময় তাতাই স্বয়ংসম্পূর্ণ একজন মানুষ হিসাবে নিজেকে তৈরি করতে পেরেছে। অক্সফোর্ডে পড়ার সময় মা প্রতি সপ্তাহে ওকে বাড়িতে আনতে যেত লন্ডন থেকে। ডরমেটরি থেকে বাড়ি না এলে খাবার বানিয়ে দিয়ে যেত বক্স ভর্তি করে সপ্তাহের জন্য। ময়লা কাপড় ধুয়ে নিয়ে আসত। ও শুধু পড়ালেখাই করত। সাউথ আমেরিকায় সান সেলভাডরে এনড্রিয়েনার বাসায় থাকার সময় নিজের সব কাজ নিজে করত। রান্না থেকে কাপড় ধোয়া। এছাড়া ওবাড়ির লোকদের সাথে ঘর সাফ বা ইয়ার্ডে কাজ করা। হাতে বাজার বয়ে আনা সব করত। প্রথম দিকে বেশ অসুবিধা হলেও ক’দিন পর বেশ মানিয়ে নেয়। যাদের বাসায় গিয়েছিল ওরা তাতাইদের মতন অতটা অবস্থাপন্ন ছিল না। তাতাই’র বাবা ইঞ্জিনিয়ার। ভালো বেতনে কাজ করেন। এছাড়া দুটো রেস্টুরেন্টের মালিক লন্ডনে যা কর্মচারীরা দেখাশোনা করত। মা তদারকি করতেন রেস্টুরেন্টের ব্যবসা।

এনড্রিয়েনাদের সবজির দোকান শহরে। গ্রামের ক্ষেত থেকে সবজি এনে বিক্রি করা ছিল আয়ের উৎস। বাবা-মা ভাইবোন সবাই কাজ করত পালা করে। খুব পরিশ্রমী ওরা। দুই ভাই দুই বোন। ফেদরিকো ও পেটরিকো দুই ভাই পড়ালেখায় আগ্রহী ছিল না। ফেদরিকো খুব ভালো গান করত। নাইট ক্লাবে সপ্তাহে তিন দিন গান করত। বাবা এবং পেটরিকো সপ্তাহে দু’দিন চৌত্রিশ কিলোমিটার দূরের লা লিভর্ভটাড সমুদ্র শহরে মাছ ধরতে চলে যেত। এনড্রিয়েনার ছোট বোন ব্রান্ডার সাথে ওর খুব ভাব হয়েছিল। মায়াবতী ঝাঁকড়া চুলের ফুটফুটে মেয়েটা প্রথম দিনেই তাতাইর মন কেড়ে নেয়। নয় বছরের মেয়েটা অবাক চোখে দেখছিল তাতাইকে, দুইজনের ভাষা আলাদা কিন্তু চোখে চোখে কথা হচ্ছিল দু’জনের। দূর থেকে ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে এসে শেষমেশ গা ঘেঁষে বসল তাতাইর। এরপর তো আঠার মতন লেগেছিল দু’জনে। তাতাই অল্প কিছু স্পেনিস বলতে পারত প্রথম অবস্থায়। ব্রান্ডার সাথে থাকতে থাকতেই ওর স্পেনিস শিখা হয়ে যায়। অনেক কেঁদেছিল মেয়েটা তাতাইর চলে আসার দিন। ওদের পরিবারের একটা মেয়ে হয়ে গিয়েছিল তাতাই। মেয়েটাকে ছোট বোনের মতন আদর করে তাতাই। আগামী বছর ও লন্ডনে আসবে পড়তে। তাতাই ওকে আনছে লন্ডনে। ভীষণ ব্রিলিয়ান্ট আর খুব ইচ্ছা ওর পড়ালেখার।

অন্য একটা দেশের সংস্কৃতি শেখার উদ্দেশ্যই তাতাইর মূলত আল সালভাডর যাওয়া। ইন্টারনেটে খুঁজে পেয়েছিল একটা মেয়ে লন্ডনে কিছুদিনের জন্য পড়তে আসতে চায়, কারো সাহায্য পেলে সে তার বাড়িতে থাকবে, বদলে তার বাড়িতে লন্ডনের ছাত্র বা ছাত্রীটি থাকতে পাবে। এনড্রিয়েনার অসম্ভব ইচ্ছা লন্ডনে আসার পড়ালেখার জন্য। একটা কলেজে ভর্তি হয়েছে কিন্তু সব খরচ সে দিতে পারবে না ডর্মে থাকার। এজন্য কারো সাহায্য দরকার। তাতাই আগ্রহী হয় ব্যাপারটায়। কোনো দেশ সম্পর্কে জানতে হলে আসলে সে দেশের লোকের সাথে বাস করতে হয়। প্রতিদিন অন্তর্জালে কথা বলে তাতাই ঠিক করে এনড্রিয়েনার সাথে তাতাই ওদের বাড়িতে গিয়ে থাকবে আর লন্ডনে এসে তাতাইর বাড়িতে উঠবে সে। এনড্রিয়েনা যে কলেজটায় ভর্তি হয়েছে সে কলেজটাও তাতাইর বাড়ির কাছে। এনড্রিয়েনার সাথেই সবচেয়ে কম কথা হয় সরাসরি। তবে প্রচুর কথা হতো অনলাইনে। এনড্রিয়েনা লন্ডনে আসার পরদিন তাতাই সালভাডরের উদ্দেশে রওনা হয়। হিথরো এয়ারপোর্টে এনড্রিয়েনাকে রিসিভ করে বাসায় নিয়ে আসে তাতাই। ওকে নিজের একটা গাড়ি চালাতে দেখেই এনড্রিয়েনার মুখ চুপসে যায়। ওদের বাড়িতে ঢুকে ও আরো ভড়কে যায়। এ তো রাজপ্রাসাদ, এমন বাড়ির মেয়ে ওদের প্রায় কুঁড়েঘরে কীভাবে থাকবে? ঠিক বুঝতে পারেনি তাতাইদের অবস্থান এনড্রিয়েনা। ওদের মতোই ভেবেছিল।

বাসায় এসে সব যখন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে তাতাই, এনড্রিয়েনা মুখ চুন করে বলে, শোনো তুমি না আমাদের বাড়িতে থাকতে পারবে না। তোমার অনেক কষ্ট হবে। অবাক তাতাই জানতে চায় কেন?
আমরা খুব গরিব। কথা শেষ করতে না দিয়ে তাতাই মুখে হাত চাপা দেয় এনড্রিয়েনার। চুপ, কিছু বল না, মাকে তো একদমই কিছু বলবে না আর তুমি চিন্তা করো না। আমি ঠিক মানিয়ে নিব। মা খাবার বাড়ায় ব্যস্ত, কিছু শুনে ফেললে শেষ মূহূর্তে যাওয়া পন্ড করে দিবে।
এনড্রিয়েনার বাড়িতে কম্পিউটার ছিল না, টেলিফোনও না। সাইবার ক্যাফে বা কলেজ থেকে তাতাইর সাথে যোগাযোগ করত। তাই ওদের বাড়ির লোকদের সাবধান করার কোনো সুযোগও ছিল না এনড্রিয়েনার। তাতাই সান সালভাডরে এনড্রিয়েনার হাতে লেখা চিঠি নিয়ে যায়। লোপানগঙ এয়ারপোর্ট থেকে সালভাডরে যাওয়ার জন্য এনড্রিয়েনাদের সবজি বহনের খোলা ট্রাক নিয়ে ফেদরিকো এসেছিল, তাতাইকে রিসিভ করতে। অনেকটা রাস্তা একসাথে যেতে প্রথম দিনের কথাবার্তায় রোমান্টিক মনের লাজুক ফেদরিকোকে খুব ভালো লেগেছিল তাতাইর। পোশাক-আসাক বিশাল সুটকেস দেখেই অনুমান করেছিল ফেদরিকো, তাতাই ওদের চেয়ে উচ্চবিত্ত ঘরের মেয়ে। লাজুক হেসে তোয়ালে দিয়ে পাশের একটা মাত্র সিট ভালো করে মুছে দিয়েছিল তাতাইর বসার জন্য ফেদেরিকো। এইটুকু বাড়তি যতœ বড় ভালোলাগা দিয়েছিল তাতাইকে।

সহজ করার জন্য তাতাই নিজে থেকে কথা বলছিল অনেক। সুন্দর একটা মিষ্টি গলা আর মন আছে ফেদরিকোর। পড়ালেখার চেয়ে গানের জন্য ওর জীবন। ও চায় বড় গায়ক হতে, অনেক নাম হবে। এড্রিয়েনা বিয়ে না করে পড়তে চায় কেন ও বোঝে না। তবে বোনটা যদি ডাক্তার হতে পারে তাহলে খুব ভালো লাগবে ওর। ছোটভাই পেটরিকোর জন্য বেশ চিন্তিত সে, পড়ালেখা করতে চায় না। গান-বাজনায়ও আগ্রহ নাই। ও শুধু টাকা বানাতে চায়। সালভাডরে দুই নাম্বার পথে টাকা বানান খুব সোজা। তবে অনেক ভয়ংকর সে রাস্তা। যাদের সাথে কাজ তারাই যে কোনো সময় মেরে ফেলতে পারে। বেশিরভাগ যুবক ছেলেরা এই নেশায় ব্যস্ত। তাই ওর খুব ভয় ছোট ভাইটির জন্য।

তাতাইকে নিয়ে ফেদরিকো যখন ওদের বাড়িতে পৌঁছাল, দিনের শেষে কাজ থেকে ফিরে সব ক্লান্ত। এনড্রিয়েনার মা রান্না করছেন আর বকবক করে কিছু বলছেন। বাবা লম্বা হয়ে শুয়ে সাদাকালো টেলিভিশনে চোখ রেখে মায়ের কথার জবাব দিচ্ছেন। টেলিভিশনের ছবি মাঝে মাঝে লাফঝাপ দিচ্ছে। ওদিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে ছোট একটা মেয়ে। বাবার পায়ের কাছে সোফার এক কোণে বসে।

তাতাই যাবে বলে বাড়তি কোনো আয়োজন ছিল না ঘরবাড়িতে বা খাবারে। মাংস, বীন, আলু সব মিলিয়ে এক ধরনের ঘন সুরুয়া আর পপসয়েস চিজ ভর্তি রুটি ।
তাতাই এনড্রিয়েনার লেখা চিঠিটা এগিয়ে দেয় রাতের খাবার শেষ হলে আর শুভরাত্রি জানিয়ে দীর্ঘযাত্রার ক্লান্তি নিয়ে শুয়ে পড়ে ওর জন্য বরাদ্দ এনড্রিয়েনার বিছানায়।
ঐ চিঠিতে হয়তো তাতাইর বাড়ির বিবরণ ছিল। পরদিন সকালে চায়ের টেবিলে ওর দিকে বাড়ির সকলের বেশি মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা অস্বস্তিতে ফেলে ওকে।

ও হঠাৎ করে উঠে দাঁড়িয়ে বেশ নাটুকে ভঙ্গীতে ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্প্যানিসে বলে, আমি কাল রাতের মতন ব্যবহার আশা করি, আজ সকালের মতন এক্কেবারে নয়। আমাকে এই ব্রান্ডার মতন ভাববে, দরকার হলে বকুনি দিবে। ঘরের কাজ করতে বলতে এতটুকু দ্বিধা করবে না কেউ। আজ সকালে খাবার টেবিলটা আমি পরিষ্কার করব, ঠিক আছে। ওরা হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানিয়ে ছিল কিন্তু খুব সহজে সহজ হতে পারছিল না, একটা অস্বস্তি যেন ঘিরে ছিল যা কাটাতে বেশ কষ্ট হয়েছে। তবে সবচেয়ে আগে পেটরিকো সহজ হয়েছিল, তুমি তো তাহলে দিদি এনড্রিয়েনার মতই মাঝে মধ্যে আমাকে টাকা দিও। মা চোখ কড়মড় করে তাকায়, বাবা রেগে ধমক দেন আর ফেদরিকো বোঝানোর চেষ্টা করে উল্টাপাল্টা কথা বলবি না। তাতাই শুধু মিষ্টি হেসে নীরব সম্মতি জানায় চোখে চোখে। পেটরিকোকে ভালোই পয়সা দিয়েছে আসার আগ পর্যন্ত তাতাই, দামি পোশাক থেকে ঘড়ি, সানগ্লাস কিনে দিয়েছে। দুবছর আগে লন্ডনে চলে আসার জন্য খুব ব্যস্ত হয়েছিল পেটরিকো। একটা কিছু ব্যবস্থা করার জন্য যোগাযোগ করেছিল তাতাইর সাথে। ও যখন বুঝতে পেরেছিল তখন পালাতে চেয়েছিল সঙ্গ ছেড়ে কিন্তু তাতাই কিছু করার আগেই ক্রাইমে জড়িয়ে পড়া পেটরিকোকে মেরে ফেলে সহযোগীরাই।

এনড্রিয়েনার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে লন্ডনে এসে পড়ালেখা করার, আর তাতাই জেনেছে মানুষের জীবন সম্পর্কে। ব্রান্ডার মতন একটা বোন পেয়েছে, ফেদরিকো পেটরিকোর মতন ভাই। এসব তাতাইকে অনেক সুখ দেয়, মায়ের কেনা মোটা মোটা জরোয়া গহনা পরার চেয়ে। মা অনেক আপত্তি করেছিল বিদেশি একটা মেয়েকে বাড়িতে রাখতে কিন্তু পরে তাতাইর মতনই আদর-যতœ করেছে এনড্রিয়েনাকে। খাওয়া তৈরি করে দেয়, কলেজে পৌঁছে দেয়। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লন্ডন শহর দেখিয়েছে। কখনো দূরে অন্য শহরগুলোতেও নিয়ে গেছে। আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি, বিয়ে, দাওয়াত সবখানেই এনড্রিয়েনাকে নিয়ে গেছে মা। যাওয়ার সময় সোনার জরোয়া নেকলেসও উপহার দিয়েছে। তাতাই হাসে এনড্রিয়েনা পড়ালেখার বাইরে লন্ডনের সঠিক জীবনের চেয়ে লন্ডনের বাঙালিদের জীবন, সাথে বিত্ত-বৈভব বেশি দেখে গেছে। লন্ডনেও যে মানুষ গরিব এবং কষ্টের জীবনযাপন করে সে সম্পর্কে ধারণা পায় নাই। আর তাতাইর মা সুরাইয়া ইউসুফের মতন মাতৃত্বসুলভ মমতার পাল­ায় পড়লে তো ছোট ছানা হয়েই জীবন কাটাতে হবে।

কিন্তু তাতাই সান সালভাডরের আসল জীবন-যাপনটা দেখে এসেছে। ওর মনে হয় জীবনে খানিক টানাপড়েন না থাকলে হয়তো জীবনকে সঠিকভাবে জানা যায় না। বিত্তবৈভব জীবনের জানার আগ্রহ নষ্ট করে দেয় কখনো। অনেক বেশি পাওয়ার পর পাওয়ার চিন্তা ছাড়া আর কিছু থাকে না মনে হয়।
এনড্রিয়ানা বারবার বলছিল তোমার তো আমাদের বাড়িতে অনেক কষ্ট হয়েছে। তাতাই অনেক মজা পেয়েছে সেটাই অনেক বেশি পাওয়া ওর কাছে। ও তো সাধারণ মানুষের সাথেই মিশতে চায়। মায়ের জন্য পারে না। মাকে কিছু বুঝতেই দেয়নি তাতাই। পড়ারই একটা কোর্স নিয়ে যাচ্ছে এমন বুঝিয়েছে। পুরো বিষয় জানলে কখনও মা যেতে দিত না। কিন্তু এ যে কত সুন্দর একটা অভিজ্ঞতা সে শুধু তাতাই জানে। তবে বাবার সাথে গোপন আঁতাতটা ঠিক ছিল। বাবা কখনো কিছুতে বাধা দেন না। একবার শুধু জানতে চাইলেন আল সালভাডর ছাড়া অন্য কোথাও গেলে হয় না? কেন বাবা, ওখানে কি অসুবিধা? আমি সেখানেই যেতে চাই। ও জায়গাটা ক্রাইমের রাজত্ব। আমার কিছু হবে না দেখো। আমি ভালো থাকব। জীবনটা জানার জন্য যেভাবে জানতে চাও জান। শুধু কোনো ক্ষতি যেন না হয় এটুকু খেয়াল রেখো। তাতাই পায়ে হেঁটে বাসে চড়ে ঘুরে বেড়িয়েছে গরিব থেকে বিত্ত-বৈভবময় এলাকায়। সব সুযোগ-সুবিধা থাকার পরও নিয়ম-শৃঙ্খলায় শিথিলতা ছিল। কিছু এলাকা বা রাস্তা ছিল ভয়ানক ক্রাইম এলাকা। যুদ্ধ শেষের কয়েক বছরের মধ্যে অরাজকতার অবস্থাটা কাটিয়ে উঠেনি তখনও। এনড্রিয়েনার মাও কিছু এলাকায় তাতাইকে একা যেতে দিতে রাজি হতেন না ওর নিরাপত্তার কারণে। এনড্রিয়েনার ভাই ফেদরিকো ওকে নিয়ে যেত সাথে করে সেসব এলাকায়। পৃথিবীজুড়ে মানুষের ব্যবহার আসলে দুই রকম─ ভালো আর মন্দ।

নানুর কথা মনে হতে সালভাডরের কথা মনে পড়ে। তেইশ বছরের জীবন সম্পূর্ণ অন্যরকমের একটা জীবন। এবার একটা নতুন ভাবনা নিয়ে চলেছে বাংলাদেশে। তাতাইর ঘড়ির সময় অনুযায়ী প্রায় দু’ঘণ্টা প্লেন চলছে পরিষ্কার রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশ। হালকা পেঁজা মেঘ ভাসছে। জানালার পাশে বসে বাইরে তাকিয়ে আছে তাতাই। কিন্তু দীর্ঘ এই যাত্রাপথ কথা না বলে থাকবে কীভাবে? চুপচাপ বসে থাকাটা কষ্টকর তাতাইর কাছে। ব্রান্ডা অবিরত ঝর্ণাধারার মতন কথা বলে। ওর সাথে থেকে কথা বলার অভ্যাসটা হয়ে গেছে। ভেবেছিল পাশের সিটে কাউকে পেয়ে যাবে মজাদার। বেশ আনন্দদায়ক হবে ভ্রমণ। নতুন মানুষের সাথে কথা হলে অনেক নতুন বিষয়ে জানা যায়। মানুষের কত বিচিত্র জীবন।
কিন্তু পাশে বসা ভদ্রলোক বোবা কিনা তাই ভাবছে এখন। অন্য কোথাও যেয়ে বসার মতন জায়গাও নেই, প্লেন লোকে লোকারণ্য।
এই লোক কোথাকার? বাংলাদেশী কী ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। বার কয়েক লোকটাকে পর্যবেক্ষণ করল তাতাই। কেমন নির্লিপ্ত বসে আছে, দুনিয়ার কিছুর প্রতিই মনে হয় খেয়াল নেই। কথা বলে দেখি কিছু বলে কিনা।
মনে মনে ভাবে তাতাই, কি বলে শুরু করবে ভাবছে, এমন সময় এয়ার হোস্টেস পাশ দিয়ে যাচ্ছিল।
তাতাই ডাকল,
─ হাই।
শুনে নাই, চলে যাচ্ছে। আসলে পেছন দিক থেকে আসছিল তাই খেয়াল করে নাই আর তাতাই আছে ভিতরের সিটে। আবার একটু জোরেই বলল,
─ এক্সকিউজ মি।
দুই সিট সামনে থেকে পেছন ফিরে তাকাল মহিলা, মুখে হাসি। পাশে বসা ভদ্রলোকও তাকাল তাতাইর দিকে।
এয়ার হোস্টেস এগিয়ে এলো তাতাইর কাছে।
─ কি চাই?
─ এক কাপ চা।
পাশের লোকও বলল,
─ আমিও চাই এক কাপ চা।
মিষ্টি করে হাসল তাতাইর দিকে চেয়ে। এয়ার হোস্টেস চলে গেলে তাতাইর দিকে ফিরে বলল,
─ ধন্যবাদ।
─ কেন, একটু অবাক তাতাই।
─ আমি বুঝতে পারছিলাম না আমিও চা পান করতে চাই। তুমি বলায় মনে হলো আমিও চা পান করতে চাই।
─ হুম! তাহলে বোবা না, বেশ মজাদার মনে হচ্ছে।
নতুন কিছু শোনার জন্য তৈরি হয় তাতাই।
এবার তাতাই জিজ্ঞেস করে সরাসরি,
─ তুমি কি লন্ডন থেকে।
─ না, নরওয়ে থেকে।
─ কতদূর যাবে?
উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন, তুমি কতদূর যাব?
─ আমি বাংলাদেশ।
─ আমিও সেখানে যাবো। তুমি কি বাংলাদেশী ?
─ হ্যাঁ, কেন?
─ বাংলাদেশীরা তাহলে তোমার মতন দেখতে।
─ ঠিক তা না, আসলে বাংলাদেশীরা এক রকম দেখতে না।
─ সঠিকভাবে আইডেন্টিফিকেশন করা যায় না।
─ এমন কেন?
─ অনেক জাতির মিলনে এক শংকর জাতি তাই কেউ কালো, কেউ ফর্সা, কাটাকাটা মুখাকৃতি আবার চ্যাপ্টা নাক-মুখের মানুষও পাবেন।
─ তুমি কোনো দেশের?
─ আমি মনে হয় শংকর একজন। এক বিষণœ ম্লান স্বর শুনে অপ্রস্তুত তাতাই পাশের লোকের দিকে ভালো করে তাকায় চোখে চোখে।
─ ইউ আর সো ইয়াং বাট ইনটেলিজেন্ট।
মৃদু হেসে তাতাই বলে,
─ কেন মনে হলো?
─ কথা বলে।
─ কোথায় যাচ্ছো, বাংলাদেশে?
─ সঠিক জানি না। আবারও ধাক্কা লাগে তাতাইর। বলে,
─ ইজ এনিথিং ইন্টারেস্টিং?
─ ইয়েস, অলওয়েজ এভরিথিং ইজ ইন্টারেস্টিং।
─ সেটা কেমন, বলা যাবে কি? ভ্র“-কুঁচকে জানতে চায় তাতাই।
খানিক সময় নিয়ে পাশের লোকটা পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখে তাতাইকে। একসময় বলে,
─ আমি…কিছু বলতে গিয়ে আবার থেমে থাকে লোকটা
─ আপনি কী?
─ আমি মানে আমি কোথা থেকে এলাম তাই জানতে যাচ্ছি।
─ খুব রহস্যময় কথা। কিছু বুঝলাম না।
─ বুঝতে সময় লাগবে, আমারও লেগেছে। চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে গা এলিয়ে বসে বলে,
─ আমি জয় এনথন ক্রিসটোফার। তোমার নামটা জানা হয়নি?
─ নভেরা ইউসুফ, নিক নেইম তাতাই।
─ বাহ সুন্দর তা তা ই, আমি কি এ নামে ডাকতে পারি?
─ স্বছন্দে।
─ তুমি কি বাংলাদেশে থাকো?
─ না, আমি লন্ডনে থাকি, বাংলাদেশে বেড়াতে যাচ্ছি।
─ কে থাকেন ওখানে।
─ মামা মামী দাদী চাচারা, অনেক আত্মীয়-স্বজন।
─ কতদিন থাকবে?
─ ঠিক নাই, মায়ের কড়া আদেশ একমাসের মধ্যে ফিরে যাওয়ার। আমার ইচ্ছা একটা প্রজেক্ট করার, যদি করতে পারি তবে অনেকদিন হয়তো নাও ফিরতে পারি।
─ আচ্ছা মাকে ফাঁকি দেয়া কেন?
Ñ মার সব কিছুতেই শুধু ভয় তাই তোমার নামটা অদ্ভুত।
─ আমার জীবনটাই অদ্ভুত…কিসের প্রজেক্ট করবে তুমি?
─ আমার প্রজেক্টের কথা এখন থাক। এখনও আমার ভিতরের স্বপ্ন। দেশে আত্মীয়-স্বজনের সাথে কথা বলে বুঝতে পারব করা যাবে কিনা। অন্তত একজন কারো সাহায্য লাগবে শুরু করতে। তোমার কথা বলো, যদি আপত্তি না থাকে শুনতে ইচ্ছা করছে।

─ যখন স্কুলে যেতাম একটু বোঝার বয়স হতে বুঝতে পারলাম আমি আর সবার মতন না। এমনকি আমার মা-বাবার মতনও না। বন্ধুরা আমাকে খেলায় নিতে চাইত না। আমার গায়ের রঙ ওদের মতন নয় বলে। আমি সবার মাঝে এক আলাদা জীব যেন। সবাই আমাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করত। কিন্তু আমার মা-বাবার কাছে আমি ছিলাম প্রাণ। তাদের বুকের মাঝে যখন জড়িয়ে রাখত, তখন পৃথিবীর কোনো দুঃখ আমাকে স্পর্শ করতে পারত না।
অনেকদিন পর আমার মা-বাবা আমাকে একটি বোন এনে দেয়। এই বোনটা ওদের মতন সাদা ধবধবে যেন বরফের টুকরো। সোনালি চুল অদ্ভুত সুন্দর। আমি খুব কান্না করতাম মনে আছে, কথা বলতে বলতে হা হা করে হাসে জয়।
─ এত হাসির কি হলো, বলো না কাঁদতে কেন? তাতাই অস্থির হয়। তখন কাঁদতে আর এখন হাসি আসছে ?
─ এখন হাসিই আসছে। আমার বোনটা আসার পর থেকে আমার কান্না আরো বেড়ে গেল। আমার ধারণা ছিল মা আমাকে ময়লায় ফেলে রেখেছে ছোটবেলায় তাই আমি কালো হয়ে গেছি। ওদের মতন ফর্সা না। হা হা হা, আবারো প্রাণখোলা হাসি হেসে উঠে জয়। মাঝে মধ্যে নিজেকে ফর্সা করার এমন অভিযান চালাতাম সাবান ঘষে ঘষে চামড়া তুলে ফেলতাম। যা পরে আরো বেশি কালো দাগে ভর্তি করে ফেলত আমার গায়।
─ কী সাংঘাতিক!
─ ঠিক আমার এই ফর্সা হওয়ার অভিযানে অতিষ্ঠ হয়ে একদিন মা আমাকে বললেন, আমাকে একটা সুন্দর গল্প বলবেন, আমি শুনতে চাই কিনা?
আমি বললাম শুনব মা বললেন গল্প বলব তবে শর্ত হলো গল্প শুনে তুমি কান্নাকাটি করতে পারবে না। তুমি এখন যথেষ্ট বড় হয়েছো। তোমার বয়স সাত। এখন তোমার একটি ছোট বোন আছে। এক বছরের মধ্যে সে তোমার কাছে কথা বলা শিখবে, গল্প শুনতে চাইবে, তুমি যা করবে তাই সে শিখবে। তাই আমি যদি শুধু কাঁদি আর সাবান ঘষে শরীরের চামড়া ছিলে ফেলি বোনটাও তাই শিখবে। আমাকে বড় হওয়ার দায়িত্ব নিতে হবে। ছোট বোনের শিক্ষক আমি, তাই আমাকে একজন শিক্ষকের ভূমিকা নিতে হবে। মা এমন সুন্দরভাবে আমার সাথে গল্প করে কথাগুলো আমাকে বুঝিয়ে বলল, আমি ভীষণভাবে নিজেকে বড়সড় একজন মানুষ ভাবতে থাকলাম। আমার খুব ভালো লাগল। নিজেকে স্কুলের শিক্ষকের মতন ভাবতে থাকলাম। মা আরো বলল, সাত দিন আমার পরীক্ষা চলবে, আমি কান্নাকাটি করি, না বড় শিক্ষকের মতন আচরণ করি এর। যদি আমি পাস করি তবে আমাকে সুন্দর গল্পটি বলবেন। সুন্দর গল্পটির জন্য অপেক্ষায় আমি নিজেকে অনেক বদলে ফেললাম। চট করে কেঁদে ফেলি না। রাগ করি না। সাবান দিয়ে ঘষে চামড়া তুলে ফেললে ফর্সা হওয়া যায় না বরঞ্চ আরো কালো হয়ে যায়, বিশ্রী দেখায়─এসব আমি ভালো বুঝতে পারি। এক রবিবার থেকে আরেক রবিবার সাত দিন সময় মা আমাকে প্রতিদিন খাতায় টিক নাম্বার দেন আমার ভালো ব্যবহারের। সাত দিন পর আমি পাস করি, শিক্ষকের মর্যাদা পাই মায়ের কাছে। এ ক’দিন আমি কান্না করিনি, রাগ করিনি, চামড়া ছিলিনি।
─ বাহ খুব সুন্দর। প্রতিটি বাবা-মায়ের তোমার মায়ের মতন এমন সুন্দর পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত।
─ আমার মা-বাবা অসাধারণ ছিলেন । যা হোক শোন,

সেদিনের কথা আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে। আমরা সুন্দর কাপড় পরে রবিবার সকালে গির্জায় গেলাম। প্রার্থনা শেষে বাইরে এসে আমার খুব প্রিয় একটা পার্ক, যার পাশ দিয়ে নদী বয়ে গেছে অনেক বোট-জাহাজ ঘুরে বেড়াত সেই নদীতে। অনেকে মাছ ধরত নৌকায় বসে। রোদেলা সকালে প্রজাপতি উড়ছিল ফুলে ফুলে। মা-বাবা ছোট বোনের পেরাটেম্বুল ঠেলে ঠেলে আমাকে নিয়ে সেই পার্কে পৌঁছালেন। আমি প্রজাপতির পিছু পিছু ছুটে বেড়াচ্ছি। বাবা আমার সাথে খেলছেন। এক সময় মা আমাকে ডাকলেন, জয়।
আমি দৌড়ে মায়ের কাছে গেলাম। মা বললেন, আজ তোমাকে গল্পটা শোনাব, তুমি কি শুনতে চাও, নাকি অন্য একদিন।
আমি হাততালি দিয়ে লাফিয়ে উঠলাম। জয়ের হাতদুটো কথা বলার মুহূর্তে তালি দেয়ার মতন একসাথে হয়ে গেল। তাতাই অবাক হয়ে দেখল সে যেন এই মুহূর্তে সেই ছোটবেলার সময়ে উপস্থিত। অত্যন্ত গভীর মনোযোগে তাতাই শুনতে লাগল জয়ের গল্প, কিছু না বলে।
মা বললেন, তাহলে এসো, এখানে শান্ত হয়ে বস। মা একটা বেঞ্চির উপর বসে আছেন পাশে পেরাটুম্বুলে ছোট বোন, বাবা এসে মার পাশে বসলেন, আর আমি তাদের সামনে একটা বড় পাথরের উপর বসলাম। খানিক সময় চুপ করে থেকে মা বলতে শুরু করলেন,
অনেক দূরের একটা দেশ আছে সে দেশের নাম বাংলাদেশ।
জয় থেমে গেল। তাতাই আবিষ্ট হয়ে শুনছিল জয়ের কথা। ও থেমে যাওয়ায় খানিক অপেক্ষা করল কিন্তু জয় আর কিছুই বলে না। অধীর তাতাই বলল কি হলো বলো, থেমে আছো কেন? আমার আগ্রহ যে দমন করতে পারছি না।
─ ভাবছি মায়ের মতন বলব, না সংক্ষেপে বলে দিব।
─ না, না, তোমার মায়ের মতন করেই বলো। আরো খানিক চুপ করে থেকে চোখ বন্ধ করে যেন মনে করে সেই সাত-বছর বয়সের স্মৃতি, জয় তারপর আবার বলতে শুরু করে।

আমি আর তোমার বাবা তখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বেরিয়েছি কেবল। কি করব ভাবছি। সে সময় একটা সাহায্য সংস্থাতে আমরা দু’জনেই কাজ নেই। সেই সংস্থা থেকে সাহায্য করার জন্য কিছু মানুষ বাংলাদেশে যাবে। আমি সেখানে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে গেলাম। বাহাত্তর সালের মার্চ মাসে আমি বাংলাদেশে গেলাম। দেশটা সদ্য স্বাধীনতা লাভ করেছে। অনেক সুন্দর একটা দেশ। সবুজ শ্যামল মাঠ, নদী, পাখি ডাকা, ফুলেফলে ভরা আর অনেক অদ্ভুত সহজ সরল মনের মানুষ সে দেশে। কিন্তু দেশটার উপর নয় মাস ধরে হয়েছে অনেক অত্যাচার, অনেক রক্তক্ষরণ। প্রিয়জন হারিয়েছে সেদেশের প্রতিটি মানুষ। কষ্ট আর কান্না বুকে সেদেশের, মানুষগুলো নতুন জীবনের ফসল বুনছে। ঘর নেই, বাড়ি নেই, রাস্তা নেই। যুদ্ধবিধ্বস্ত অনেক মানুষ। এত কষ্ট তাদের তারপরও নতুন উদ্দীপনায় উজ্জীবিত তারা দেশটাকে গড়তে। আমরা সেই যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মানুষদের সাহায্য করছি। খাবার, ঔষধ, কাপড়, বাসনপত্র দিয়ে। চিকিৎসা সেবা সুশ্র“ষা দিয়ে নয় মাসে শারীরিক, মানষিকভাবে অসুস্থ, বিদ্ধস্ত মানুষদের সাহায্য করছি। মায়ের গল্প আমার মনে অচেনা এক দেশের ভাঙ্গাচুরার মাঝে সুন্দর এক ছবি বসিয়ে দিতে লাগল।
আমার কল্পনায় ভাসতে লাগল এক সবুজ দেশ। মা বললেন, সেই সবুজ দেশের মানুষগুলো অত ফর্সা না, এই তোমার মতন রঙ। সেই দেশের এক মা তার সদ্য জন্ম নেয়া ছোট্ট ছেলেটাকে আমার কাছে রেখে গিয়েছিল। যুদ্ধে ওর ঘর ভেঙে গেছে, একদিন ঘর বানান হলে ফিরে এসে নিয়ে যাবে বলে। আমি সে ছেলেটাকে বুকে করে রাখলাম। অনেক আদর আর যতœ করে। একসময় আমার কাজের সময় শেষ হয়ে গেল সে দেশে। ছোট বাচ্চাটার মা আর ফিরে এলো না। আমি অনেক অপেক্ষা করলাম। বাচ্চাটাকে আমি এতদিনে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি, তাকে আমি রেখে আসতে পারি না। বাচ্চাটা আমাকে ততদিনে মা বলে ডাকতে শিখে গেছে। তাকে আমি ভাঙ্গা ঘরে থাকার জন্য রেখে আসতে পারি না। মা তো আর ফিরে এলো না। সেই ছোট্ট বাচ্চাটাই আমার জয়।
─ তাতাই মুগ্ধ বিস্ময়ে জয়ের হাত চেপে ধরে। জয় হেসে ফেলে ওর দিকে তাকিয়ে তারপর বলে,
─ আমি কিন্তু আর কাঁদিনি আমার রঙ কালো বলে। সাবান ঘষে চামড়াও তুলিনি আর কখনো। মনে মনে এক শ্যামলা মায়ের মুখ আঁকতাম। তার ঘর বানানো শেষ হলো কিনা জানতে খুব ইচ্ছা করত, এত বছর পর তাই সে খোঁজ করতে যাচ্ছি। এখন কি সে আমাকে রাখতে পারবে। তার কি ঘর বানানো শেষ হয়েছে?
─ তোমার মায়ের ঠিকানা তাহলে তোমার কাছে আছে?
─ না নেই, তার ঠিকানা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করব।
গল্পে গল্পে সময়ের খবর ছিল না। এয়ার হোস্টেস লাঞ্চ সার্ভ করতে এলো।
প্রায় নিঃশব্দে খাবার শেষ করল তাতাই। ও আচ্ছন্ন হয়ে আছে জয়ের গল্পে। তবে একটা মা কেন সন্তানকে এভাবে দিয়ে দিল একজন বিদেশির হাতে তুলে, বিষয়টা সুস্পষ্ট না। একজন বাংলাদেশী ছেলে বিদেশি একটা পরিবারে বড় হয়েও বুকে ধারণ করে আছে বাংলাদেশ। যে দেশ সে কোনোদিন দেখেনি, দেখেনি আপন মা-বাবা। কেমন অবাক করা এক অনুভূতি, তাতাই সব মিলাতে পারে না। হঠাৎ মনে হয় জয় বলেছিল সে শংকর, তাহলে কি জয়ের মায়ের কোনো বাংলাদেশী লোকের সাথে সম্পর্ক হয়েছিল? জয়ের বাবা তো তখন ছিল না ।
খাওয়ার পর ব্ল্যাক কফি নিল জয়। লম্বা চুমুক দিয়ে তাতাইকে ডাকল লম্বা করে,
─ তা তা ই─
─ বলো।
─ তুমি চুপ হয়ে গেলে যে।
─ তোমাকে খাওয়ার সময় দিচ্ছি।
─ আচ্ছা চালাক মেয়ে বেশি ভাবছো নাতো?
─ নাহ, কি ভাবব। তাতাই মিষ্টি করে হাসে, তবে একটা কথা ঠিকই ভাবছি।
─ বলে ফেলো।
─ তুমি কীভাবে এই বিশাল জনসমুদ্রে তোমার মাকে খুঁজবে?
─ জানি না, তবে মনে হয় তুমি সাহায্য করবে।
─ আমি! অবাক তাতাই।
─ হুম, তাইতো তোমার সাথে দেখা হয়ে গেল, মজা করে জয়।
─ তুমিও দুষ্ট কম না দেখি, হাসে তাতাই। ব্যাগ খুলে একটা কার্ড দেয়, এই যে এটা রাখো, আমার মামার কার্ড। আমি এখানে থাকব। বলা যায় না তোমার সাহায্যে আসতেও পারি।
─ কার্ডটা রাখতে রাখতে জয় বলে, আমার কাজ আমি নিজেই করব। তবে পরিচয় যখন হলো একসাথে ঘুরতে মাঝে মধ্যে ভালোই লাগবে। তুমি আমাকে দেশটা দেখাতে পারবে।
─ তা পারব। তুমি তো একেবারেই নতুন। আমার কিছুটা চেনাজানা আছে ।
─ তোমার প্রজেক্টের ব্যাপারে একটা ধারণা পেতে পারি কী?
─ কী করব এখনো কিছু ঠিক করিনি। তবে মেয়েদের জন্য যদি কোনো কাজের ব্যবস্থা করতে পারি সে চেষ্টা করব।
─ ভালো, আই উইল হেলপ ইউ।
─ থ্যাংক ইউ।
─ তোমার বরফের মতন সাদা বোনটা কি করছে?
─ ও সত্যি শিক্ষক হয়ে গেছে। জেসিকা স্কুলে পড়ায়। বিয়ে হয়েছে। ওর দুটো ছোট ছোট ফুটফুটে বাচ্চা আছে। জেসিকার খুব ইচ্ছা ছিল আমার সাথে যাওয়ার বাংলাদেশে কিন্তু ছোট বাচ্চার জন্য যেতে পারছে না। জেসিকার ছোট আরো একটা বোন আছে আমার মিখিলা। ও অস্ট্রেলিয়ায় পড়ালেখা করছে মেডিকেল সাইন্সে।

 

টরন্টো, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent