বুধবার - মে ৮ - ২০২৪

দীর্ঘশ্বাসের সাথে বসবাস: সমকালীন জীবনের চিত্র

ছবিফ্রি পিক

মনের অলিগলিতে যা ঝংকার তুলতে পারে, তাই কবিতা। মনের বিষণ্নতা দূর করতে যেমন কবিতা পড়া চাই, তেমনি নিজেকে সমৃদ্ধ করতেও কবিতার পাঠ অপরিহার্য। সম্প্রতি হাতে এসেছে কবি ও কলামিস্ট আবুল খায়েরের কাব্যগ্রন্থ ‘দীর্ঘশ্বাসের সাথে বসবাস’।  এই বইয়ের প্রতিটি কবিতার বৈশিষ্ট্যই আলাদা।

দেশ নিয়ে তার বর্ণনা পাঠক-হৃদয় ছুঁয়ে যায়। ঘামে ভেজা কৃষক, ফসলের মাঠ, পুকুর ডোবায় ফোটা শালুক, সাঁঝের বেলার পাখি, বর্ষার রিমঝিম বৃষ্টি, সবুজ লতা, শীতের কুয়াশা, নতুন ভোর, সোনালি আঁশ কোনো কিছুই কবির চোখ এড়ায়নি, বাঁধা পড়েছে তার কবিতায়। প্রকৃতি যেমন কবিকে মুগ্ধ করেছে, তেমনি অনাচার তাকে ক্ষুব্ধ করেছে। পেশীশক্তির বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় দাম নিয়ে খোলা হাতে কবিতা লিখেছেন। আড়তদার, ঋণ খেলাপি, ভেজাল পণ্য বিক্রেতা, পুঁজিবাদী সমাজকে কটাক্ষ করেছেন। নির্ভীক চিত্তে বলেছেন, ‘জীবনের ছন্দ বাড়ে না ক্যান পণ্যের দামের মতো/ পুঁজিবাদের পেশী শক্তি দেখবো আর কত।’ মানবতাকেই কবিধর্ম বলেছেন তিনি। ধর্মের কথা বলে অধর্মের কাজ করাকে ঘৃণা করেছেন। ধর্ম নিয়ে যারা  বাড়াবাড়ি করে, তারা  আসলে অসুর।

- Advertisement -

নীমতলির আগুন, অসহায় মানুষের আর্তচিৎকার, ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে অসার জীবন, বেঁচে থাকার আকুল প্রার্থনা পাঠকের বিবেককে নাড়া দেবে। আগুনের লেলিহান শিখা নিষ্পাপ সন্তানকে পুড়িয়ে ছাই করার দৃশ্য চোখ দুটোকে পোড়াবে নিরন্তর। অসহায় বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসা সন্তানদের কটাক্ষ করেছেন কবি। বৃদ্ধ মানুষগুলোর ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, নিদ্রাহীন রাত, ভারাক্লান্ত মন কবিকে উদাস করেছে, কষ্ট দিয়েছে। ধনী-গরিবের বৈষম্য চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ‘তোমরা ও আমরা’ কবিতায়।

একদিকে ধনীরা যেখানে খাদ্য অপচয় করে, অন্যদিকে গরিবরা সেই খাদ্যের জন্য কেঁদে মরে। কবি বলেন, ‘তোমার কাছে অখাদ্য যা আমরা সেটা খাই/ তুমিও যেমন বাঁচতে চাও আমরাও বাঁচতে চাই’। বর্তমান সময়ে ক্যাসিনো একটি আলোচিত বিষয়। ক্যাসিনো নিয়ে লেখকের ক্ষুরধার লেখা ‘ভাগ্য বদলের যন্ত্র।’ স্বাধীনতা আমাদের অস্তিত্ব।

কবি এই বিষয়টি নিয়ে নিখুঁতভাবে কবিতায় মালা গেঁথেছেন। মার্চের কালো রাত, পাক সেনাদের উম্মাদ অত্যাচার, ঘুমন্ত মানুষের আহাজারি, স্বাধীনতা সংগ্রাম, বিজয়ের পতাকা বিস্তারভাবে কবিতায় উঠে এসেছে। ভালোবাসার মানুষের উপর চাপা অভিমানের কবিতা ‘কখনো বলা হবে না’ ‘আমার ভালোবাসার নিক্তি জগৎ যে ভারী, তা বোঝার ক্ষমতা সবার থাকে না। হয়তো তুমি, বুঝবে না। ক্যামন করে বুঝবে? তুমি তো অনেক দূরে, অনেক দূরে।’
সম্প্রতি ‘রিফাত’ হত্যা মামলার রায় দিয়েছেন আদালত। ‘রিফাত’ হত্যার প্রতিবাদে কবি কলম তুলে নিয়েছেন হাতে। এছাড়া তার কবিতায় উঠে এসেছে বিশ্বজিত, আবরার ও নুসরাত হত্যার প্রসঙ্গও। ‘সময়ের বচন’ নামে একটি কবিতা রয়েছে এই বইয়ে।  কবি বলেছেন, ‘সময় এখন নয় ঘুমাবার/ জড়ো হও জাগ্রত জনতার/ মুষ্টিবদ্ধ হাত ওপরে তুলবার।’ ‘বিবর্ণ স্বদেশ, স্বদেশ প্রেম, মজলুমের তর্জনী’ ইত্যাদি কবিতাগুলোতে কবি বিপন্ন জনপদ, শকুনের কবলে দেশ এসব বিষয় ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘পতিতা’ কবিতায় কবি নেতাদের পতিতার সঙ্গে তুলনা করেছেন। সমাজের অনাচার দূর করতে আমজনতাকে রুখে দাঁড়াতে বলেছেন।

প্রতিবাদের হাত দাও গুঁড়িয়ে, পায়ের নিচে পিষিয়ে থেঁতলিয়ে স্তব্ধ করো সব কণ্ঠ, আছে যত অর্বাচীন ভণ্ড মাথা হোক সব নত অবনত, সততা, বদান্যতা আজ মৃত। ‘আমার কীর্তি যাবে না বিফলে’ কবিতায় কবি আশাবাদী হয়েছেন তার সুকীর্তি চিরকাল রইবে। কবিদের পান্ডুলিপি একসময় কথা কইবে। কবিতার শব্দ বুননে নির্ঘুম রাত বিফলে যাবে না। যায় না কখনো। জাতির কালিমা, ডেঙ্গু, মায়ের জন্য শপথ, ড্রেনের আবর্জনা, মানবতার শ্বেত আরকসহ আরও চমৎকার বিষয়গুলো নিয়ে কবিতা লিখেছেন।

বইটি পড়তে গিয়ে আমি বারবার আবেগ আপ্লুত হয়েছি, কখনো আপন মনে হেসেছি,  কখনো মনের কোণে মেঘ জমেছে। তবু সব মিলে চমৎকার একটি সমসাময়িক কবিতার বই ‘দীর্ঘশ্বাসের সাথে বসবাস’।

 

ইষ্টইয়র্ক, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent